৯৯+ প্রেমের উক্তি, প্রেম নিয়ে ক্যাপশন, রোমান্টিক প্রেমের বাণী, স্ট্যাটাস, কিছু কথা

প্রেমের উক্তি, প্রেমের ক্যাপশনঃ প্রেম হলো আবেগীয় বিষয় যা মানুষের হৃদয়ের সাথে সম্পর্কিত। যদিও প্রেম চোখে দেখা যায় না তবে এর অনুভূতি খুবই ধা’রা’লো। এই অনুভূতি মানুষকে যেমন সুখের স্বর্গে পৌঁছে দেয় তেমনি আবার ন’র’কে’ও পাঠায়। প্রেমে পড়লে মানুষ সাধারণত বোকা হয়ে যায়, তবে আবার বোকারা হয় চালাক। কি অদ্ভুত না বিষয়টা! প্রেম নিয়ে ক্যাপশন বা রোমান্টিক প্রেমের বাণী পড়লে আমরা প্রেমের রসায়ন কিংবা প্রেমের বদনা সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা পেতে পারি। প্রেমের স্ট্যাটাস বা প্রেম নিয়ে কিছু কথা লিখতে গিয়ে আজ মনে পড়ে যায় প্রিয়জনের কথা। প্রেম কতই-না মধুর আবার কতই-না বেদনাদায়ক। ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্রাম এ আজকাল প্রেম নিয়ে বাণী বা স্ট্যাটাস দেখা যায়। কিন্তু অনেকেই সঠিক জ্ঞানের অভাবে ঠিকমতো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন না। তাদের জন্য আমাদের আজকের আয়োজন প্রেম নিয়ে উক্তি-র ৯৯ টি বাছাইকৃত কালেশন-

প্রেম নিয়ে উক্তিঃ
০১। তুমি যদি আমাকে মনে রাখো, তাহলে অন্য সবাই ভুলে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না।
– হারুকি মুরাকামি

০২। ভালোবাসা মানে শুধু বৃষ্টির সময় কারো হাত ধরে হাটা নয়, ঝড়েও মধ্যেই সেই হাতটি ধরে রাখার মনমানসিকতা।
-রেদোয়ান মাসুদ

০৩। জীবন হলো সেই ফুল যার জন্য ভালোবাসা হলো মধু।
– ভিক্টর হুগো

০৪। তুমি যা পাওয়ার আশা করো তার সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই – শুধু তুমি যা দেবে তার সাথে – যা সবকিছু।
– ক্যাথারিন হেপবার্ন

০৫। আমি তোমাকে অসংখ্যভাবে ভালোবেসেছি, অসংখ্যবার ভালোবেসেছি, এক জীবনের পর অন্য জীবনেও ভালোবেসেছি, বছরের পর বছর, সর্বদা, সবসময়।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

০৬। সত্যিকারের ভালোবাসা হলো নিজের আগে অন্য কাউকে রাখা।
— ফ্রোজেন

০৭। প্রেমের জন্মই হয়েছে অভিনয় থেকে, তাই যে যত বড় অভিনেতা সে তত বড় প্রেমিক।
– রেদোয়ান মাসুদ

০৮। আমাদের আত্মা যা দিয়েই তৈরি হোক না কেন, তার ও আমার আত্মা একই।
– এমিলি ব্রোন্টে

০৯। ভালোবাসায় সর্বদা পাগলামি থাকে। কিন্তু পাগলামির মধ্যে সর্বদা কিছু কারণও থাকে।
–ফ্রেডরিখ নিটশে

১০। মেয়েরা প্রথমবার যার প্রেমে পড়ে, তাকে ঘৃনা করলেও ভুলে যেতে পারে না। পরিষ্কার জল কাগজে পড়লে দেখবেন তা শুকিয়ে যাওয়ার পড়েও দাগ রেখে যায়।
– সমরেশ মজুমদার

১১। আমি যেখানেই যাই না কেন, আমি সবসময় তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার পথ জানতাম। তুমি আমার কম্পাস তারকা।
— ডায়ানা পিটারফ্রেন্ড

১২। যারা অতিরিক্ত ভালোবাসা পায় তারা ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না। তারা সব সময় ভালোবাসাকে অবহেলা করে। জীবনের একটা সময় গিয়ে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদে কিন্তু ভালোবাসা তখন আর ধরা দেয় না। কারণ সময় ঠিকই প্রতিশোধ নেয়।
— রেদোয়ান মাসুদ

১৩। ভালোবাসা হলো আগুন, কিন্তু এটি আপনার চুলা উষ্ণ করবে নাকি আপনার ঘর পুড়িয়ে দেবে, আপনি কখনই বলতে পারবেন না।
— জোয়ান ক্রফোর্ড

১৪। আমার তোমাকে এমনভাবে দরকার যেমন হৃদয়ের স্পন্দনের দরকার হয়।
— ওয়ান রিপাবলিক

১৫। জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ হলো এই দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের ভালোবাসা পাওয়া হয়; নিজেদের জন্য ভালোবাসা, অথবা বরং নিজেদের সত্ত্বেও ভালোবাসা।
– ভিক্টর হুগো

১৬। ভালোবাসা অনেকটা পিঠের ব্যথার মতো, এটি এক্স-রেতে দেখা যায় না, তবে আপনি জানেন যে এটি সেখানে আছে
– জর্জ বার্নস

১৭। তুমি যাকে পেয়েছ সে হয়তো তোমাকে ভালোবাসে কিন্তু তুমি যাকে হারিয়েছ সে তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসে না।
-রেদোয়ান মাসুদ

১৮। ভালোবাসা হলো দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া দিয়ে তৈরি একটি ধোঁয়া।
– উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

১৯। যাকে ভালোবাস তাকে চোখের আড়াল করো না।
– বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

২০। প্রেমে দুটি জিনিস আছে – শরীর ও শব্দ।
–জয়েস ক্যারল ওটস

২১। প্রেমের বন্যায় বধু হায় দুই কুল আমার ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া যায়।
–কাজী নজরুল ইসলাম

২২। মানুষের প্রেমে পড়ার জন্য মাধ্যাকর্ষণ দায়ী নয়।
– আলবার্ট আইনস্টাইন

২২। তোমার সাথে দেখা করার আগেই আমি জানতাম আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি সারা জীবন অপেক্ষা করে আসছি।
– স্যাভেজ গার্ডেন

২৩। সোনায় যেমন একটু পানি মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেইরকম ভালোবাসার সঙ্গে একটু শ্রদ্ধা, ভক্তি না মিশালে সে ভালোবাসাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
– নিমাই ভট্টাচার্য

২৪। যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানে জীবন আছে।
– মহাত্মা গান্ধী

২৫। প্রকৃত প্রেমিক হলেই ভালোবাসা পাওয়া যাবে না, ভালোবাসা পেতে হলে আপনাকে হতে হবে প্রকৃত অভিনেতাও।
– রেদোয়ান মাসুদ

২৬। আমরা যখন প্রেমে থাকি তখন আমরা সবচেয়ে বেশি জীবিত থাকি।
– জন আপডাইক

২৭। ভালোবাসা একে অপরের দিকে তাকানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একই দিকে বাইরের দিকে তাকানোর মধ্যে রয়েছে।
– অ্যান্টোইন ডি সেন্ট

২৮। প্রেম মানুষকে সংযমী, চরিত্রবান, বলবান, সাধনার দৃঢ়বান করে, যুবককে সংগ্রামশীল, মস্ত ও গৌরবশীল করে।
– লুৎফর রহমান

২৯। ভালোবাসা স্বর্গের মতো, কিন্তু এটি নরকের মতো আঘাত করতে পারে।
– অজানা

৩০। ভালোবাসা তোমার আত্মাকে তার লুকানোর জায়গা থেকে বের করে আনে।”
– জোরা নিল হার্স্টন

৩১। ভালোবাসা ভালোবাসা নয় যতক্ষণ না তুমি তা ত্যাগ করো।
— অস্কার হ্যামারস্টাইন

৩২। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম।
– হুমায়ূন আজাদ

৩৪। আমি চাই না তুমি সভ্য হয়ে যাও, তোমার চোখদুটি সভ্য হয়ে যাক। আমি চাই তোমার চোখদুটি অসভ্যই থাকুক। যেদিন তোমার ঐ চোখদুটি সভ্য হয়ে যাবে সেদিন বুঝে নেব আমার প্রতি তোমার আর কোনো ভালোবাসা নেই।
– রেদোয়ান মাসুদ

৩৫। জীবন হলো সেই ফুল যার জন্য ভালোবাসা মধু।
— ভিক্টর হুগো

৩৬। তুমি যদি একশ বছর বেঁচে থাকো, তাহলে আমি একশ দিন কম বাঁচতে চাই যাতে তোমাকে ছাড়া আমাকে আর কখনও বাঁচতে না হয়।
— এ. এ. মিলনে

৩৭। তোমাকে ভালোবাসা কখনোই একটি বিকল্প ছিল না। এটা একটা প্রয়োজনীয়তা ছিল।
— সত্য গ্রাসকারী

৩৯। ভালোবাসা হলো অপ্রতিরোধ্যভাবে আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা।
— রবার্ট ফ্রস্ট

৪০। এই জীবনে শুধু একটি সুখ আছে, ভালোবাসা ও ভালোবাসা পাওয়া।
—জর্জ স্যান্ড

৪১। প্রেম মানে দুজনের কাছে দুজনের আত্মসমর্পণ।
— রেদোয়ান মাসুদ

৪২। আমি তাকে ভালোবাসি ও এটি সবকিছুর শুরু।
— এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড

৪৩। সত্যিকারের প্রেমের গল্পের কখনো শেষ থাকে না।
— রিচার্ড বাখ

৪৪। ভালোবাসা এমন কিছু যা স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে যাতে আপনি চিন্তিত হন।
— ডলি পার্টন

৪৫। ভালোবাসা: একটি অস্থায়ী পাগলামি, বিবাহের মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।
— অ্যামব্রোস বিয়ার্স

৪৬। তোমার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে জ্বলজ্বল করে যেমন সূর্য পৃথিবীতে জ্বলে।
— এলেনর ডি গুইলো

৪৭। কখনো কখনো আপনার যা দরকার তা হলো সঠিক ব্যক্তির কাছ থেকে আলিঙ্গন ও আপনার সমস্ত চাপ গলে যাবে।
— অজানা

৪৮। ভালোবাসা হলো বেঁচে থাকার ইচ্ছার চূড়ান্ত প্রকাশ।
— টম ওল্ফ

৪৯। ভালোবাসা মানে এই নয় যে কাউকে বিয়ে করতেই হবে, কখনও কখনও ভালোবাসার মানুষের সুখের জন্য বুকের ভেতরে শত যন্ত্রণা ঢেকে রেখে হাসি মুখে প্রিয় মানুষটিকে বিদায় দিতে হয়।
– রেদোয়ান মাসুদ

৫০। আরও একবার ও সর্বদা আরও একবার ভালোবাসাকে বিশ্বাস করার যথেষ্ট সাহস রাখুন।
– মায়া অ্যাঞ্জেলো

প্রতীক্ষা পর্ব – ৬

সুখ ও শোক ২টাই এক ধরনের বিলাসিতা যা পুরুষের ক্ষেত্রে আসলে মানায় না। সবুরের অবস্থা ঠিক এরকমই হয়েছে। পরিবারের সবাইকে হারিয়েও ভাইদের সাথে কাজে লেগে যায় সে। যদিও সবাই তাকে বাধা দিয়েছিল কিন্তু তাতে পাত্তা দেয়নি সবুর। একা মানুষ, ভাইদের সাথে খেয়ে-পরে জীবন পার করতে পারবে। কিন্তু সে এটাও জেনে গেছে, সামনে আরও বড় যুদ্ধ আসছে। অন্নের যুদ্ধ। এতদিন ভাইদের খেতে কাজ করে মজুরি নিলেও এখন আর নেয় না। ভাইয়েরা টাকা দিতে চাইলেও তার এক কথাÑ সে এই টাকা নিয়ে কাদের পেছনে খরচ করবে?
যেদিন যেই ঘরে একটু ভালো সালুন রান্না হয় সেদিন সেই ঘরে তার ডাক পড়ে। তাছাড়া তার কোনো ঘরও নেই এখন। জীর্ণ-শীর্ণ যেই ঘরটি তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ঘরটি আর নতুন করে মেরামতের উপযোগী ছিল না। তবে অন্ন রাঁধতে ঠিকই কাজে লাগছে। ইতোমধ্যে এটি ভেঙে লাকড়ি বানানো হয়েছে। আর এই লাকড়ি পোড়ার উত্তাপেই এখন তাদের চুলায় ভাত ফোটে। কথায় আছেÑ হাতি মরলেও এক লাখ, বাঁচলেও এক লাখ। ওইরকম অবস্থাই হয়েছে ঘরটির।

সবুর তার চোখ দুটি মেলতে পারে না, সামনে ভেসে ওঠে স্ত্রী-সন্তানদের ছবি। বিশেষ করে ছোট্ট মেয়েটির ছবি তার চোখের সামনে থেকে কোনোভাবেই সরে না। বৃষ্টিতে পানি জমা খেত থেকে যখন সে বাটি দিয়ে বালতিতে পানি উঠাচ্ছিল তখন তার চোখের জলও টপটপ করে পড়ছিল। জীবনভর কাজ করেই বড় হয়েছে সে। তাই এক বালতি পানি তার কাছে কিছুই না। কিন্তু চোখের জল পড়া বালতির পানি যে সেদিন তার কাছে কত ভারী লেগেছিল তা সে-ই জানে।
আজ দুই-তিন মাস পেরিয়ে গেছে। এলাকার বউ-ঝিরা তাকে বিয়ে করানোর জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। এমনকি তার শ্বশুর-শাশুড়িও বলেছেন বিয়ে করতে। তাদের মেয়ে কিংবা নাতি-নাতনিদের কোনো চিহ্ন নেই। নতুন বিয়ের পরে জামাইয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক ছেদ হবে। অথচ এটা জেনেও তারা তাদের জামাইকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন। এটাই বাংলাদেশের নিয়ম। পুরুষের বউ মরছে তো বিয়ে করতে হবে। পারলে তো আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা পরের দিনই বিয়ে করিয়ে দেয়। সবুরের এক কথাÑ এখন সে বিয়ে নিয়ে ভাবছে না। তাছাড়া খেতের ফসল তোলার সময় হয়ে এসেছে। এখন যে তার এক বিন্দুও সময় নেই। কথায় আছেÑ যার কাজ নেই তার কাজের অভাব নেই। সবুরকে যে এখন সব ভাইয়ের কাজ করে দিতে হয়।

অবশেষে ফসল তোলা শুরু হলো। প্রতি বছর এই সময়ে সবার মুখে যে হাসি থাকত এবার আর তা নেই। যেই ফসল হয়েছে তা দিয়ে খরচের অর্ধেকও উঠবে না। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। সবুর ওয়াদুদের সাথে রসুন-পিঁয়াজ তুলছে। সাথে দিনমজুরও আছে। বাচ্চা ছেলেমেয়ে ও মহিলারা পিঁয়াজ-রসুনের শিকড় ও আগা কাটছে। দিনমজুরেরা প্রতিদিন বিশ টাকা করে পাচ্ছে। আর যারা পিঁয়াজ রসুনের শিকড় ও আগা কাটছে তারা প্রতি মণ পেঁয়াজে পাচ্ছে পাঁচ টাকা আর রসুনে পাচ্ছে দশ টাকা। চাঁদনী গামছায় বেঁধে ভাত নিয়ে এসেছে। কিন্তু খেতের আইলে দাঁড়িয়ে তার দেবর সবুরের দিকে চোখ পড়লে সে থমকে দাঁড়ায়। চেহারার দিকে তাকানো যায় না। মুখের ওপর যেন উত্তর আকাশের মেঘ জমে আছে।
দেবরের প্রতি খুব মায়া হলো তার। তাই খেতের মধ্যে কাটা রসুনের পাতার ওপর ভাতের পাত্র রেখে সে সবুরকে ধরে এনে বসাল। তারপর স্বামী ওয়াদুদকেও ডাকল। সবুর ভাত খেলেও তার চোখদুটি একেক দিকে ঘুরতে থাকে। বিষয়টা লক্ষ করছে চাঁদনী। সবুরের পাতে ভাত শেষ হলেও সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। চাঁদনী আবার ভাত আর সালুন উঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইজান, একটা কতা কই?’ বড় ভাই সামনে, তাই সবুর চোখের ইশারায় চাঁদনীকে থামতে বলল। চাঁদনী আর কোনো কথা বলল না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে স্বামী ও দেবরের খাওয়া দেখতে লাগল।

ফসল তোলা শেষ হলো। যার যতটুকু ফসলই হোক না কেন, আপাতত সবাই একটু বিশ্রাম পেল। তবে চাঁদনীর কি আর সেই সুযোগ আছে? রান্নাবান্নাসহ বাড়ির কাজ তো সব সময়ই থাকে। কিন্তু যেই ফসল বাড়িতে আনা হয়েছে এগুলো নিয়ে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। কাঁচা পিঁয়াজ বিক্রি করে দেওয়া হয় সাথে সাথেই। রসুন কেউ বিক্রি করে, আবার কেউ বাড়িতে এনে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে। কিন্তু ধনে মসুর নিয়ে অনেক ঝামেলা। এগুলো পিটিয়ে গাছ থেকে আলাদা করতে হয়। এরপর শুকিয়ে ঘরে তুলতে হয়। একদিন চাঁদনী ধনে পিটাতে পিটাতে ক্লান্ত হয়ে পানি খেতে কলের কাছে যায়। এ সময় সে দেখল সবুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখ মোছে আবার আনমনা হয়ে আগের মতোই তাকিয়ে থাকে। চাঁদনী কিছু না বলে কলে চাপ দিয়ে পানি খেয়ে না দেখার ভান করেই চলে আসে। কিন্তু সবুর টের পেয়েছে কি না কে জানে? সে মনের দুঃখে কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে রইল।

রাত বারোটা। পৌষ মাস প্রায় শেষের দিকে। চারদিক কুয়াশায় মোড়ানো। নীরব নিস্তব্ধ পৃথিবী। সারাদিনের ক্লান্তিতে চাঁদনী একেবারে মরার ঘুম ঘুমিয়েছে। এই শীতের মাঝেও সে কাঁথা ছাড়াই শুয়ে আছে। ওয়াদুদ বিষয়টা লক্ষ করে চাঁদনীকে নিজের উমে জড়িয়ে নিয়ে কাঁথাটি ওপরে দিয়ে দিলো। চাঁদনী ‘উহ’ করে একটু আওয়াজ করে ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরে নীরব হয়ে গেল। শীতে কাঁপছে চাঁদনী। কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকার পর তার কাঁপা থামল। ওয়াদুদ অবশ্য তাকে বাহুবন্দি করে মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ফলে ঘুম ভেঙে যায় তার। স্বামীর শরীরের উম আর আদরে তার সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে। কিন্তু সে যে জেগেছে তার কিছুই বুঝতে দিলো না।
ওয়াদুদ আদর দিয়েই যাচ্ছে। তারও মন চায় ওয়াদুদকে আদর দিয়ে এর প্রতিদান দিতে। এ সময় তার সেদিনের বলা কথা মনে পড়ে গেল। ‘এই উমে যদি অন্য কেউ বাসা বান্ধে।’ কথাটা মনে করে সে সবুরের কথা ভাবতে থাকে। কীভাবে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আবারও নতুন কারও সাথে জীবন জোড়া লাগে। যদিও সবুর এখনো একাই আছে। তবে লাগতে আর কতক্ষণ!
এর মধ্যে ওয়াদুদ চাঁদনীকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলল, ‘হুনছো?’ চাঁদনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে-ও ওয়াদুদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না হুইনা আর উপায় কী?’
‘তয় আমাগো তো আরেকটা বাচ্চা দরকার, তাই না?’ এই বলে ওয়াদুদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এর কারণ অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না চাঁদনীর। তারপরেও না শোনার ভান করে বলল, ‘হেইডা বুজলাম, তয় বাইত্তে যে একজন মানুষ একা একা আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে হেইদিকে কি খেয়াল আছে তোমার?’
‘হেইদিন তো খেতে বইয়া কইতে যাইয়াও কইলা না, তয় আমি তো আর কইতে পারি না। তুমিই কাল কইয়ো।’ এই বলে ওয়াদুদ চাঁদনীর অশান্ত বুকে মাথা রেখে ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে আবার বলল, ‘এইহানে আমি আবার আমার সন্তানের নড়াচড়ার শব্দ হুনতে চাই।’

চাঁদনীর চোখ দুটি টলটল করছে। স্বামীর দেওয়া এত সুন্দর অনুভূতির মাঝেও সে যে কেন কাঁদছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। ওয়াদুদ তাকে মাতাল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু চাঁদনী যেন বিষিয়ে একেবারে নিথর হয়ে গেল। হঠাৎ ওয়াদুদের হাতে কয়েক ফোঁটা জল পড়তেই সে হকচকিয়ে ওঠে। সাথে সাথে চাঁদনীর চোখে হাত দিয়ে দেখে চোখে জলের ধারা নেমেছে। ‘তুমি কানতাছ চাঁদনী? কী হইছে তোমার? আমারে খুইলা কও।’ চাঁদনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে আবার সে কয়লার মতো জ্বলে উঠল। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে ডুকরে কাঁদতে লাগল। অনেক চেষ্টার পরে অবশেষে চাঁদনী শান্ত হলো। কিন্তু কী জন্য কাঁদল তা বলল না সে। কারণ জানার জন্য ওয়াদুদ বেশি জোরাজুরি করলে চাঁদনী নিজেই আবার ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল। একসময় ক্লান্ত দুজন ঘুমিয়ে পড়ে। আর এদিকে মাকড়সার জালে শিশির জমে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে টপটপ শব্দ হতে থাকে। কিন্তু সেই শব্দ আর তাদের কানে গেল না।

‘ভাইজান, আপনার সাথে আমার একটা কতা আছে?’ কথাটা শুনে সবুর কেঁপে ওঠে। চোখের সামনে হাজির হয় তার দুই ছেলে ও মেয়ের সেই নিষ্পাপ মুখগুলো। হাজির হয় হতভাগা, কপালপোড়া আকলিমাও। আকলিমা যেন তাকে হাত উঁচিয়ে বলছে, ‘সবুর, তুমি আরেকটা নিকা করো, তোমার এই একাকিত্ব আমার যে আর সয় না।’ সবুরের শুকিয়ে যাওয়া চোখের তটিনীতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জলের রেখা ফোটে উঠছে। তারপরেও ছেঁড়াফাটা গামছা দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘কন ভাবি।’
‘কী কমু তা আপনি আগেই বুঝতে পারছেন। তারপরেও কই ভাইজানÑ আপনি আরেকটা নিকা করেন। একলা একলা আর কয়দিন এইভাবে থাকবেন? আপনের দিকে তাকাইলে আমি আর স্থির থাকতে পারি না।’ কথাগুলো নতুন না। একই কথা ওইদিন কাজলীও বলে গেছে। কাজলীর কথা মনে করে সবুরের বুকের মাঝে হাহাকার করে উঠল। ‘আহা কাজলী! তোমার বুকের ভেতর জইমা থাকা পাহাড়সমান কষ্টই হয়তো আমার চোকে আইজ ঝরনা হইয়া ঝরতাছে। কাজলী তুমি কি সত্যি সত্যিই আমারে অভিশাপ দিছিলা? একদিন না তুমি কইছিলাÑ তোমার কষ্ট মানে আমার কষ্ট। তয় কষ্ট যদি তোমারও হয় তাইলে ক্যামনে অভিশাপ দিলা? না না, আমার কাজলী এই অভিশাপ দিতে পারে না।’ মনে মনে কথাগুলো বলে হু হু করে কেঁদে উঠল সবুর।
‘ভাইজান, মনে মনে কী কইতাছেন? দ্যাহেন কাইন্দেন না। আল্লায় যা করে ভালোর নিগ্গাই করে।’
কথাটার কোনো জবাব দিলো না সবুর; শুধু মনে মনে বলল, ‘হ, আইজ আমি অনেক ভালো আছি, অনেক ভালো!’ ‘ভাইজান রাগ করলেন? এহন তো কোনো কাজ কাম নাই। এতদিন কইছেন জিরাত উডতাছে, অনেক কাম।’
‘আমার চিন্তাগুলা তো আর কেউ কইরা দেয় না বইন, আমি যে আইজ ক্লান্ত। আমি আর পারতাছি না ভাবি। হতভাগা বউডা আর আমার পোলাপানগুলা…!’ আর কোনো কথা বলতে পারল না সবুর। দাঁতে দাঁত লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।
জ্ঞান ফিরলে সবুর দেখে তার সামনে কাজলী বসে আছে। সেদিন সে তাকে যেই চেহারায় দেখেছিল আজ আর তা নেই। ‘আহা স্বামীহারা মাইয়াডা! তাইলে কি ওরও পুরান কতা মনে পইড়া গ্যাছে সব? আর তাতে জ্বইলা পুইড়া এই অবস্তা হইছে?’ সবুর চারদিকে তাকায়। পেছনে তার ভাবি চাঁদনীও বসে আছে। হয়তো সে-ই কাজলীকে ডেকে এনেছে। চাঁদনী এটা জানে, কাজলীর কথা ওয়াদুদ ফেলতে পারবে না।
অনেক আগের কথাÑ সবুরের প্রেমে টালমাটাল কাজলী। কাজলীর স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিলেন তার বাবা। গ্রামে তিনি কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছেন না। আশেপাশের এমন কেউ নেই যে এই প্রেমের কথা জানে না। সবুর প্রায়ই চিঠি পাঠায় চাঁদনীকে। চাঁদনীও ফিরতি চিঠিতে জবাব দেয়, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে। পিয়ন হিসেবে কাজ করে চাঁদনীর এক চাচাতো বোন সায়মা। তবে এর জন্য সে বিনিময় নিত। সবুর তাকে এটা সেটা কিনে দিতো।
একদিন সবুর একটি চিঠি লিখে চাঁদনীকে পাঠায়। চাঁদনী সেদিন বাড়িতে ছিল না। তাই সায়মা চিঠিটি কাজলীর বইয়ের মধ্যে রেখে আসে। কাজলীর বাবা টেবিলের বইগুলো এলোমেলো দেখে গুছিয়ে রাখতে গেলেন। এ সময় একটি বই তার হাত থেকে মাটিতে পড়ে যায়। তাতে বইয়ের পৃষ্ঠা খুলে একটি কাগজ কিছুটা বেরিয়ে আসে। মনে হচ্ছে যেন একটি অজগর শিকারকে গিলতে গিয়ে আর পারেনি, তাই মাথাটা বাইরে বেরিয়ে আছে। কাজলীর বাবা অজগরটির মুখ থেকে শিকারটিকে টেনে বের করলেন।

প্রিয় কাজলী,
নিশ্চয়ই ভালো আছ। আর ভালো না থাকার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। জীবনটা খুব সুন্দর তাই না কাজলী? আসলে তোমার সাথে সম্পর্কে না জড়ালে বিষয়টা বুঝতামই না। তাই আমিও বলছিÑ অনেক ভালো আছি। একজন কাজলী যার পাশে আছে তার কি আর ভালো না থাকাটা মানায়? তাছাড়া তোমার ওই টানা টানা চোখ আর সফেদ মুখটি দেখলে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তাই কয়দিন যাবৎ দেখা না হওয়ায় মনটা অস্থির হয়ে আছে। সেদিন তোমার স্পর্শ নিয়ে বাড়ি ফিরে আমার মনে হয়েছে এমন স্পর্শ যদি প্রতি মুহূর্তে পেতাম তাহলে জীবনটা কতই-না মধুর হতো। তোমারও কি এমন অনুভূতি হয়? রাত বাড়ছে। হারিকেনের চিমনিতে কালি পড়ে আছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার শুধু তোমার কথাই মনে পড়ছে। দেখা হবে শীঘ্রই। ভালো থেকো। চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি তোমার অক্সিজেন সবুর

৩০+ ক্ষমা নিয়ে উক্তি, ক্ষমা নিয়ে ক্যাপশন, স্ট্যাটাস, বাণী, কিছু কথা

ক্ষমা নিয়ে উক্তি, ক্ষমা নিয়ে ক্যাপশনঃ ক্ষমা হচ্ছে মানব জীবনের একটি মহৎ গুন, যা সবার মধ্যে থাকে না। তবে যে ক্ষমা করতে পারে সেই হলো প্রকৃত মানুষ। ক্ষমা মানুষের মনকে সুন্দর করে আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ক্ষমা করলে বিধাতাও খুশি হন। যিনি ক্ষমা করেন তার ভুলও বিধাতা ক্ষমা করে দিতে পারেন। তাই জেদ না চেপে রেখে মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন। ক্ষমা নিয়ে উক্তি কিংবা ক্ষমা নিয়ে ক্যাপশন পড়লে আমরা ক্ষমার গুনাগুণ সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে পারি। তাছাড়া যারা ক্ষমা নিয়ে ফেসবুক কিংবা ইন্সটাগ্রামে স্ট্যাটাস দিতে চান তারা ক্ষমা নিয়ে উক্তি-গুলো পড়তে পারেন। আজকে আমাদের আয়োজন ক্ষমা নিয়ে বাণী। চলুন তাহলে শুরু করা যাক-

 

০১। ক্ষমা মানুষের গভীরতম চাহিদা ও সর্বোচ্চ অর্জন।
―হোরেস বুশনেল

০২। কাউকে ভুলতে চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিন, না হলে জীবনেও তাকে ভুলতে পারবেন না।
— রেদোয়ান মাসুদ

০৩। নিজেকে ক্ষমা করা ব্যক্তিগত জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করে।
— ডেভিড ডি. বার্নস

০৪। ক্ষমা কেবল আমরা যা পাই তা নয়; এটি আমরা যা দিই তাও।
— ওগও ডেভিড এমেনিকে

০৫। রাগের মাথায় কারো ভুলের শাস্তি দেবেন না। মনে রাখবেন আগুনে কিন্তু লোহাও পুড়ে যায়। আর সেই লোহাটা হলেন আপনি।
— রেদোয়ান মাসুদ

০৬। ক্ষমা হচ্ছে ভালোবাসা বেছে নেওয়া। এটি আত্ম-দানকারী ভালোবাসার প্রথম দক্ষতা।
— মহাত্মা গান্ধী

০৭। ক্ষমা করা ভালোবাসার সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে সুন্দর রূপ। বিনিময়ে, আপনি অকথ্য শান্তি ও সুখ পাবেন।
― রবার্ট মুলার

০৮। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকিছুকে আলিঙ্গন করুন এবং ভালোবাসুন। দ্রুত ও যতবার প্রয়োজন নিজেকে ক্ষমা করুন। নিজেকে উৎসাহিত করুন। নিজের সম্পর্কে ভালো কিছু বলুন।
— মেলোডি বিটি

০৯। নিজেদের ক্ষমা করতে দেওয়া হলো সবচেয়ে কঠিন নিরাময়গুলোর মধ্যে একটি যা আমরা গ্রহণ করব।
— স্টিফেন লেভাইন

১০। মানুষ যদি তার নিজের ভুল বুঝতে পারে বা স্বীকার করে নেয় তাহলেও এক ধরনের ক্ষমা চাওয়া হয়ে যায়।
— রেদোয়ান মাসুদ

১১। তোমার হৃদয়ে ভালো রেখে করা ভুল এখনও একটি ভুল, কিন্তু এটি এমন একটি যা তোমার নিজেকে ক্ষমা করতে হবে।
— লিন্ডা সু পার্ক

১২। ক্ষমা তোমার জন্য কারণ এটি তোমাকে মুক্ত করে। এটি তোমাকে সেই কারাগার থেকে বের করে দেয় যেখানে তুমি নিজেকে রেখেছিলে।
— লুইস হে

১৩। আত্ম-ক্ষমা হচ্ছে নম্র, শক্তিশালী ও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের একটি দৈনন্দিন অভ্যাস। এটি অভ্যন্তরীণ শান্তির একটি ইচ্ছাকৃত সংরক্ষণ ও একটি সুস্থ আত্ম-ধারণার প্রতিফলন।
― শ্যানন ট্যানার

১৪। শান্তি না পাওয়ার জন্য নিজেকে ক্ষমা করুন।
― একহার্ট টোলে

১৫। অপমান হলো একটি তির, যতই ভুলতে চাইবেন ততই হৃদয়ের গভীরে বিদ্ধ হবে।
— রেদোয়ান মাসুদ

১৬। নিজের প্রতি করুণা বোধ করা কোনওভাবেই আমাদের কর্মের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয় না। বরং, এটি আমাদের সেই আত্ম-বিদ্বেষ থেকে মুক্তি দেয় যা আমাদের জীবনে স্পষ্টতা ও ভারসাম্যের সাথে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধা দেয়।
— তারা ব্রাচ

১৭। সত্য হলো যদি না তুমি ছেড়ে দাও, যদি না তুমি নিজেকে ক্ষমা করো, যদি না তুমি পরিস্থিতিকে ক্ষমা করো, যদি না তুমি বুঝতে পারো যে পরিস্থিতি শেষ হয়ে গেছে, তাহলে তুমি এগিয়ে যেতে পারবে না।
— স্টিভ মারাবোলি

১৮। অতিরিক্ত জেদ ও আত্মসম্মান মানুষকে এতই চেপে রাখে যে এক সময় তা পাথর হয়ে যায়, যা ভাঙার ক্ষমতা আর নিজের কাছে থাকে না।
— রেদোয়ান মাসুদ

১৯। আমি যদি নিজেকে ক্ষমা না করতাম, তাহলে আমি কাউকে এতটা ভালোবাসার মতো শক্তিশালী হতে পারতাম না।
— ডন লানুজা

২০। আমাদের দুঃখ ও ক্ষত তখনই সেরে যায় যখন আমরা করুণার সাথে তাদের স্পর্শ করি।
— বুদ্ধ

২১। আপনার নেতিবাচক ভেতরের কণ্ঠস্বরের শব্দ কমিয়ে দিন ও তার স্থান দখল করার জন্য একটি লালনশীল ভেতরের কণ্ঠস্বর তৈরি করুন। যখন আপনি ভুল করেন, তখন নিজেকে ক্ষমা করুন, তা থেকে শিখুন ও এটি নিয়ে আচ্ছন্ন না হয়ে এগিয়ে যান। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অন্য কাউকে আপনার ভুল বা ত্রুটি নিয়ে ভাবতে দেবেন না বা আপনার কাছ থেকে পরিপূর্ণতা আশা করবেন না।
— বেভারলি এঙ্গেল

২২। আপনি যত বেশি নিজেকে জানবেন, তত বেশি আপনি নিজেকে ক্ষমা করবেন।
― কনফুসিয়াস

২৩। প্রথমে নিজেকে ক্ষমা করুন। আপনার মনে বারবার নেতিবাচক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজনীয়তা ছেড়ে দিন। সর্বদা আপনার ভুলগুলো পর্যালোচনা ও পুনরুজ্জীবিত করে আপনার অতীতের কাছে জিম্মি হয়ে উঠবেন না। নিজের কী হওয়া উচিত ছিল বা কী হতে পারত তা মনে করিয়ে দেবেন না। এটি ছেড়ে দিন, এগিয়ে যান।
― লেস ব্রাউন

২৪। আজ রূপের আগুনে যে আপনাকে জ্বালাচ্ছে কাল অনুশোচনার আগুনে সে নিজেই জ্বলবে।
— রেদোয়ান মাসুদ

২৫। আপনি চিরকাল সেখানে বসে থাকতে পারেন, আপনি কতটা খারাপ ছিলেন তা নিয়ে বিলাপ করতে পারেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দোষী বোধ করতে পারেন, এবং সেই অপরাধবোধের একটি ক্ষুদ্র অংশও অতীতের কোনো জিনিস পরিবর্তন করতে পারে না। নিজেকে ক্ষমা করুন, তারপর এগিয়ে যান!
— ওয়েন ডায়ার

২৬। নিজেকে ক্ষমা করুন – অন্য কেউ করবে না।
— মায়া অ্যাঞ্জেলো

২৭। নিজেকে ক্ষমা করো। ক্ষমার সর্বোচ্চ কাজ হলো যখন তুমি তোমার জীবনে সৃষ্ট সকল ক্ষতের জন্য নিজেকে ক্ষমা করো। ক্ষমা হলো আত্ম-ভালোবাসার একটি কাজ। যখন তুমি নিজেকে ক্ষমা করো, তখন আত্ম-গ্রহণ শুরু হয় এবং আত্ম-ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
— মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল রুইজ ম্যাকিয়াস

২৮। আপনার মতো কেউ আপনার ব্যথা এতটা অনুভব করতে পারে না বা কখনো অনুভব করবে না। অতীতের জন্য নিজেকে ক্ষমা করুন, বর্তমান মুহূর্তের উপহারটি গ্রহণ করুন।
— কে.জে. কিল্টন

২৯। বন্ধুকে ক্ষমা করার চেয়ে শত্রুকে ক্ষমা করা সহজ।
— উইলিয়াম ব্লেক

৩০। মানুষের দুটি মহান আধ্যাত্মিক চাহিদা রয়েছে। একটি হচ্ছে ক্ষমা আর অন্যটি হচ্ছে সদাচরণের জন্য।
— বিলি গ্রাহাম

৩১। ক্ষমা হচ্ছে সেই সুবাস যা বেগুনি রঙের গোড়ালিতে ছড়িয়ে পড়ে তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
— মার্ক টোয়েন

প্রতীক্ষা পর্ব – ৫

খেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের জমি উঁচুতে তাদের কিছুটা ভালো আছে আর যাদের জমি নিচু সেখানে পানি জমে রসুন-পিঁয়াজ পচে গেছে। গ্রামের মানুষ থালাবাটি নিয়ে খেতে নেমেছে। জমিতে জমে থাকা পানি সেচছে। যদি কিছু হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাকি নেই। এসেছে নতুন বউ আমেনাও। কেউ ড্রেন কাটছে, কেউ পানি উঠিয়ে বালতিতে ভরছে, আবার কেউ সেই বালতির পানি নিয়ে ড্রেনে ফেলছে। এ যেন এক মহাকর্মযজ্ঞ। সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখেই সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করছে। আস্তে আস্তে খেতের পানি শুকাচ্ছে আর বেরিয়ে আসছে ক্ষত। পিঁয়াজ-রসুনের পাতা ঢলে পড়ছে। জমি একেবারে শুকিয়ে ফাটল ধরলে দেখা গেল উঁচু জমির ফসলগুলোতে কিছু গুছি দিলেই হবে কিন্তু নিচু জমিগুলো আবার চাষ দিয়ে নতুন করে ফসল বুনতে হবে।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বেশির ভাগ মানুষের বাড়িঘর নষ্ট হয়ে গেছে। গাছপালাও ভেঙে পড়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। গৃহপালিত পশু-পাখিও মারা গেছে অনেক। এর মধ্যে আবার নতুন করে ফসল চাষ করা কতটা কঠিন তা এই গ্রামবাসীই ভালো জানে। উঁচু জমি যাদের তারা অল্প কিছু পিঁয়াজ রসুন কিনে ফাঁকা জায়গায় গুছি দিলো। আর নিচু জমিতে চাষ দিয়ে সবাই ধনে-মসুরি বুনল। কারণ এখন আর পুরো খেতে নতুন করে পিঁয়াজ-রসুন কিনে লাগানোর মতো সক্ষমতা কারও নেই। তাছাড়া লাগালেও তা ভালো হয় না। কারণ এই ফসল আসতে আসতে অনেক শীত পড়ে যাবে। অতিরিক্ত কুয়াশায় পিঁয়াজ-রসুনের পাতায় মড়ক ধরে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। কারওই তেমন মন ভালো নেই। তারপরেও সবাই চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়াতে। ফয়েজকে নিয়ে খেতে নিড়ানি দিচ্ছে গফুর। হঠাৎ প্রকৃতির ডাক পড়লে সে খালের পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে। এর মধ্যে হঠাৎ করে কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দেয়। রাগ আর ক্ষোভে তার শরীর জ্বলছে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখে তার ছেলে রাশেদ হাসছে। মূলত প্রকৃতির কাজ সারার সময় রাশেদই তাকে ধাক্কা দিয়েছে। ফয়েজ যতটা ভয়ংকররূপে পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল ততটা আর থাকেনি। কিন্তু সে-ও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। রক্তের প্রবাহ একেবারে থামল না। খাল থেকে ওপরে এসেই ছেলের গায়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিলো। ওই যে এর আগে যেই লোকটি রাশেদকে টাকা দিয়েছিল, সেদিন কিন্তু সে-ই এই কাজটি করতে পারত। কিন্তু করেনি। বরং পাঁচটি টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাশেদকে দিয়েই বাবার সাথে কাজটি করাল। আর বাবাকে দিয়েই ছেলের বিচার করাল। রাশেদকে থাপ্পড় দিয়েও রাগ যাচ্ছে না গফুরের। তবে বারবার দাঁত চেপে ধরে সেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে সে।

কল্পনার মন-বাগানে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। গফুরের ঘরে সংসার করার মূল যে আকর্ষণ সেটাই নেই। সেটা অবশ্য কখনোই ছিল না। তবে সে বানিয়ে নিয়েছে। বাগানের মালিক গফুর হলেও মালির দায়িত্বটা ফয়েজের। কিন্তু সবুরের পুরো পরিবার মারা যাওয়ার পরে মালি আর বাগান পরিচর্যা করতে আসে না। বাড়িতে খুব কাজের চাপ। এত শোকের মাঝে শ্বাস বন্ধ লাগছিল আমেনার। তাই অনেক বলে কয়ে সে তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
এখন ফয়েজের বিয়ের আগের অবস্থাই হয়েছে কল্পনার। একা একাই সব কাজ সামলাতে হচ্ছে তাকে। চুলায় ভাত চড়িয়ে দিয়ে একটা ঝাড়ু নিয়ে সে পুরো উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসে আবার ঝাড়ু দেয়। কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না সে। ইদানীং তার শরীরটাও খুব জ্বলছে। অবশ্য দোষটা মনেরই। মন যা চায় তা পাচ্ছে না বলেই শরীরে যন্ত্রণা করছে। এ সময় খেত থেকে বাড়ি ফেরে ফয়েজ। খেতে নিড়ানি দিচ্ছে তারা। প্রচণ্ড কাজের চাপ। ফলে দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। ফয়েজ খেয়ে গফুরের জন্য ভাত নিয়ে যাবে। কল্পনা ভাত বেড়ে দেয়, আবার ফয়েজের দিকে তাকায়। ফয়েজের পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, তাই সে গোগ্রাসে ভাত গিলছে।

এর মধ্যে একটি মাছের কাঁটা তার গলায় বিঁধে। সাথে সাথে সে তার ভাবি কল্পনাকে দেখতে বলে। কিন্তু কল্পনার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। তার চোখের নদীতে বিন্দু বিন্দু জলের রেখা জমে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। ‘কী হইছে ভাবি? এমনে কানতাছো ক্যান?’ এই বলে সে নিজেই গলায় হাত দিয়ে মাছের কাঁটাটা বের করে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ল। কল্পনা ভেবেছিল তার চোখে জল দেখে ফয়েজও কাঁদছে। তাই নিজের বিরহ কাটিয়ে সে ফয়েজকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘থাক কাইন্দ না, সময় খারাপ হইলে সবদিক দিয়াই হয়।’
‘কই কানলাম, গলার মইদ্দে থেইকা কাঁটা বাইর করলাম তাই চোকে জল চইলা আইছে।’ এই বলে ফয়েজ সেই আগের মতোই তাড়াহুড়া করে খেতে লাগল। দেবরের চোখে জল দেখে কল্পনা যে একটু সান্ত্বনা পেয়েছিল তা একেবারে উবে গেল। রাগে তার শরীর জ্বলছে। তাই মুখ খুলে বলেই ফেলল, ‘শুদু নিজের প্যাডের দিক তাকাইলেই হয় না, অন্যেরটাও দ্যাখতে হয়।’ কল্পনা যে এটা দিয়ে কী বুঝিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইল না ফয়েজের। তবে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে খেতের দিকে পা বাড়াল। আর এদিকে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকা কল্পনা বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ফয়েজের চলে যাওয়া দেখতে লাগল।

গফুর আলাদা ঘুমায়। এটা অবশ্য বিয়ের প্রায় বছরখানিক পর থেকেই। কল্পনার এক কথাÑ গফুর যদি তার সাথে ঘুমায় তাহলে সে এই বাড়িতে থাকবে না। প্রায় আট বছর আগের কথা। রাগ করে সে বাপের বাড়িতে চলে যায়। কারণ গফুরের নাকি শারীরিক সমস্যা আছে। বাবার কাছে লজ্জায় কিছুই বলতে পারে না কল্পনা। তাই সে তার মা জয়নাবান নেছাকে সব কথা খুলে বলে। তিনি আবার তার স্বামী মুবারক আকনকে জানান। মুবারক আকন তার স্ত্রীকে বলেন মেয়েকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে।
অতঃপর জয়নাবান নেছা কল্পনাকে অনেক বুঝান। তার এক কথাÑ ওইটাই তো সবকিছু না। সংসার বলতে আরও অনেক কিছুই আছে। সুতরাং বাকিসব যদি ঠিক থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে স্বামীর সংসারে ফিরতে হবে। তাছাড়া তারা অনেক গরিব। কল্পনাকে বিয়ে দিতে তাদের অনেক ধার-দেনা করতে হয়েছে। সেই দেনাই এখন পর্যন্ত শোধ হয়নি। মাসে মাসে কিস্তি দিতে হয়। ফলে মুবারক আকনের সংসার চালাতে খুব হিমশিম খেতে হয়। অবশ্য কল্পনাদের পরিবারের সাথে গফুরের পরিবারের আত্মীয়তাও মানায় না। কিন্তু কল্পনার ওই সফেদ মুখটি দেখেই তারা আত্মীয়তা করে। যদিও গফুরের বড় ভাই রাগ করে বিয়েতেই যায়নি, তারপরেও গফুরের একক সিদ্ধান্তে এই বিয়ে হয়।

কল্পনাকে পেয়ে গফুরের মনের নদীতে যেই বাঁধভাঙা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা বেশিদিন প্রবাহিত থাকেনি। বছর না ঘুরতেই সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। জয়নাবান নেছার শত চেষ্টার পরেও গফুরের সংসারে না ফেরার বিষয়ে অটল থাকে সে। ফয়েজের তখন বয়স কম। কিন্তু হঠাৎ করে বেশ লম্বা হয়ে যায় সে। চুল রাখে বড় বড়। দেখতে একেবারে প্রিন্সের মতো। সব ভাইয়েরা কাজ করে আর সে ঘুরে ফিরে খায়। সবার ছোট বলে কেউ তাকে কিছু বলেও না। যখন যা চায় তাই পায় সে। তাছাড়া অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে কেউ তার সামনে কখনো জোরেও কথা বলেনি।
ভাবি বাড়িতে আসে না। বিষয়টা তার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। কল্পনা এ বাড়িতে যতদিন ছিল ফয়েজ তার পিছু পিছু লেগে থাকত। মনে হতো যেন দুজন একেবারে ভাই-বোন। তাছাড়া কল্পনারও বয়স কম। কেবল কলি থেকে ফুল ফোটেছে। সে-ও দেবরের সাথে কোনো বাধা ছাড়াই হইহল্লা করত, ঘুরে বেড়াত। প্রথম দিকে স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার গোপন সম্পর্ক নিয়ে কল্পনার তেমন একটা মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু যখন সে ফুল ফোটে একেবারে পাপড়ি মেলতে শুরু করল তখন বুঝতে পারলÑ আসলে ভাত-কাপড়ই সব না, তার সাথে মনের ক্ষুধাও আছে। কিন্তু মনের ক্ষুধা না মিটলে যে শরীরটা খুব জ্বালায়।
কল্পনা বাবার বাড়িতে একরকম জোর করেই থাকছে। মনে হচ্ছে যেন এ বাড়িতে তার আর কোনো অধিকার নেই। বিয়ে হয়েছে তো বাবা-মায়ের কাছে পর হয়ে গেছে। যেখানে নিজেদেরই ভাত জোটে না সেখানে বিয়ে দেওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনা যেন একটা বিলাসিতা। বিকেল বেলা পশ্চিম আকাশে টকটকে লাল সূর্য বিদায়ের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এখনো পেটে কিছু না পড়ায় ক্ষুধায় পেট জ্বলছে কল্পনার। মুবারক আকন ভোর বেলায় পান্তা ভাত নিয়ে কামলা দিতে গেছেন । কল্পনা ভাত খেতে যায়। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার মা কয়েকটি কচুরমুখি গরম পানিতে জ্বাল দিচ্ছেন। এগুলো অবশ্য তিনি রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে তুলে এনেছেন। কল্পনা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাত রান্ধ নাই মা?’ জয়নাবান নেছা অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। পাশে থাকা বটিটি উঁচু করে কল্পনার দিকে তাক করে বললেন,
‘এইহানে কি তোর কোনো ভাতার আছে যে তোর নিগ্গা চাইল আইনা রাখছে?’ মায়ের এমন হিংস্রমুখ কল্পনা কখনোই দেখেনি। ঘরে ভাত থাকত না অথচ নিজেরা না খেয়ে কল্পনার জন্য রেখে দিতেন। কল্পনা জিজ্ঞেস করলে তারা বলতেন, ‘আমরা রান্ধনের সময়ই খাইয়া হালাইছি।’ কথাগুলো মনে করে কল্পনার চোখের তটিনীতে বান নামল। চারদিকে সে আবছা দেখছে। পায়ের নিচের মাটি মনে হয় সরে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনোরকমভাবে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সে ঘাটায় এসে একটি মাচার ওপর বসল। এর মধ্যে তার কানে ভেসে এলো ছেলেকণ্ঠ, ‘ভাবি আমার খুব ক্ষুদা লাগছে, শিগগির ঘরে যাইয়া ভাত বাড়ো।’

ফয়েজ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে হাজির। সারাদিন দোকান থেকে হাবিজাবি খেলেও তাতে পেট ভরেনি তার। তাছাড়া তার ভাবিও যেহেতু বাড়িতে আছে সেই চিন্তা করেই সে এ বাড়িতে এসেছে। কল্পনা সাথে সাথে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল এক সিনেমার নায়ক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবড়ি চুল, শুকনো শুভ্র মুখ আর বিড়ালের মতো চোখ। সে-ও হয়তো তাকেই খুঁজছিল। কারণ তার এই দুরবস্থার মধ্যে কোনো নায়ক ছাড়া তো তাকে এত দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব না।
কল্পনা ফয়েজের কাছে গিয়ে একটি মিথ্যে হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি তো একটু নানা বাইত্তে গেছিলাম, এইমাত্র আইলাম। আর বাবা মায় এহনো আহে নাই। তাই ভাত রান্নাও হয় নাই। চলো তোমাগো বাইত্তে চইলা যাই এহন। বাইত্তে যাইয়াই ভাত খামুনে দুজন।’ ফয়েজ আর না করতে পারল না। এর মধ্যেই কল্পনা দৌড়ে ঘরে গিয়ে তার কাপড়ের ব্যাগটি এনে ফয়েজের হাতে দিয়ে বলল, ‘চলো তাইলে।’

জয়নাবান নেছা মেয়েকে অনেক অপমান করে এখন নিজেই জ্বলেপুড়ে মরছেন। যেখানে নিজেরা না খেয়ে মেয়েকে খাওয়াতেন সেখানে আজ মেয়ের মুখে সামান্য একটু অন্নও তুলে দিতে পারলেন না। বরং মেয়ের ওপর বঁটি নিক্ষেপের জন্য তাক করেছিলেন। ছেঁড়াফাটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন আর বোবা কান্না করছেন তিনি। তারই-বা কী করার ছিল? স্বামী কামলা দিয়ে টাকা রোজগার করে হাটে গিয়ে চাল আনবেন। তারপরই কেবল ভাত রান্না করতে পারবেন।
কচুমুখিগুলো সিদ্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো নামিয়ে তিনি ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। মেয়ে ক্ষুধার্ত, এখন কী করা যায়? হঠাৎ মনে পড়ল রান্নাঘরেই হাঁস-মুরগির জন্য কিছু খুদ রাখা আছে। তাই সেই খুদ বের করে কুলায় করে ঝেড়ে কিছু খুদ পাতিলে দিয়ে রান্না চড়িয়ে দিলেন। আর কচুমুখিগুলো ঠান্ডা হলে ভর্তা বানানোর জন্য ছুলতে লাগলেন। অতঃপর সরিষার তেল আর পোড়া মরিচ দিয়ে সেগুলো ভর্তা করলেন। ভাত রান্না হয়ে গেলে মাড় গেলে গামলায় বাড়লেন। এরপর পানির কল থেকে এক জগ পানিও আনলেন।
সবকিছু সম্পন্ন করে ঘরের কাছে গিয়ে কল্পনাকে ডাকলেন, ‘কল্পনা, এই কল্পনা। ভাত বাইড়া বইয়া আছি। শিগগির চুলাহালে আয়।’ মেয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি সাথে সাথেই ঘরের ভেতর গিয়ে আরও কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু কল্পনার কোনো খবর নেই। অতঃপর তিনি ঘাটায় গিয়েও কয়েকবার ‘কল্পনা, কল্পনা’ বলে জোরে জোরে ডাকলেন।
বয়সের স্রোতে জয়নাবান নেছার ভাঁজপড়া কপালে কালো মেঘ জমছে। ছানিপড়া চোখের কোণেও বিন্দু বিন্দু জলের রেখা ফুলে ফেঁপে উঠছে। এখন কী করবেন তিনি? কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। এদিকে ছেলেটাও বাড়িতে নেই যে তাকে বলবেন কল্পনাকে খুঁজে বের করতে। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি আবার রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় জ্বলতে থাকা কয়লার খাঁখাঁ আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে যেন এই কয়লার আগুন তার বুকেই জ্বলছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। হাঁসমুরগিগুলো খোঁয়াড়ের কাছে এসে ডাকছে। হয়তো জয়নাবান নেছার অপেক্ষাতেই আছে। অবশেষে জয়নাবান নেছা এসে এগুলোকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিলেন। এগুলোর জন্য অবশ্য খারাপও লাগছে তার। কারণ হাঁসমুরগির জন্য রাখা খুদগুলোই যে তিনি রান্না করে ফেলেছেন। তার কান্না আরও বেড়ে গেল। সহ্য করতে না পেরে তিনি আবার ঘরের ভেতর চলে গেলেন। একটা বাতি ধরিয়ে কল্পনার রুমে গিয়ে দেখলেন তার জামাকাপড়ের ব্যাগটিও নেই। এর মধ্যে মুবারক আকন চাল-ডাল হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে গলায় ডাকলেন, ‘কল্পনা, এই কল্পনা। শিগগির বাতি নিয়া বাইরে আয়।’
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি জয়নাবানকে ডাকলেন, ‘এই হুনছো? শিগগির বাতি নিয়া বাইরে আহো।’ জয়নাবান অবশ্য ‘কল্পনা, কল্পনা’ ডাক শুনেই বাতি নিয়ে বাইরে এসেছেন। স্ত্রীর চোখে জল দেখে মুবারক আকন সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার চোকে জল ক্যান? আর কল্পনা কই?’ জয়নাবান আর কোনো কথা বলতে পারলেন না, স্বামীর কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চোখ ভাসিয়ে বোবা কান্না করতে লাগলেন।

প্রতীক্ষা পর্ব – ৪

লাঙল দিয়ে চাষ দেওয়া খেতের ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা বড় বড় চাকার ওপর বসে কতকগুলো পাখি পোকা-মাকড় খাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তারা দ্বীপের মধ্যে জেগে থাকা পাথরের ওপর বসে মাছ শিকার করছে। এ যেন তাদের উৎসব! পেটভরে খাওয়ার উৎসব! পাখিদের এই উৎসবে বাদ সাধল ওয়াদুদ। বড় বড় চাকাগুলো ভাঙতে ও খেত সমান্তরাল করতে বলদ ও মই নিয়ে মাঠে নেমেছে সে। মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বলদ দুটিকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে আর সেগুলো দৌড়াচ্ছে। তবে পাখিগুলোও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। ওয়াদুদ যেদিকে মই দেয় তার উলটো দিকে গিয়ে পোকা-মাকড় শিকার করছে তারা।

ওয়াদুদ এক খেতে রসুন লাগিয়েছে আর এই খেতে লাগাবে পিঁয়াজ। পিঁয়াজ-রসুনের ভালো ফলনের জন্য খেতের চাকা অনেক মিহি করতে হয়। আজ মই দিয়ে সেই কাজটিই করছে সে। তবে থেমে নেই তার স্ত্রী চাঁদনীও। সে বাড়িতে বসে রোপণের জন্য কেনা ছোট পিঁয়াজগুলো বাছাই করে ঝেড়ে প্রস্তুত করছে। তার ছেলে চয়ন কিছুটা বড় হলেও পিঠ ছাড়ে না সহজে। অনেক সাধনার পরে চয়নের জন্ম হয়েছে। তাই সবার কাছে আদরও একটু বেশি। কিন্তু ফসল চাষের ধুম পড়ায় কেউ আর তাকে কোলে নিতে আসে না। তাই চয়নকে বুকে জড়িয়েই সে সকল কাজ সারছে। এটা তাদের জীবন-মরণের লড়াই। বর্ষাকালে ধান-পাট হলেও এই সময়ের ফসলই তাদের মুখে সবচেয়ে বেশি হাসি ফোটায়। এই ফসল বিক্রি করেই তাদের সারা বছর চলে।

সবুরকে নিয়ে একটা একটা করে পিঁয়াজ মাটিতে পুঁতছে আর নতুন স্বপ্ন বুনছে ওয়াদুদ। তার একটাই ইচ্ছা, চয়নকে সে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। এর জন্যই তাকে এখন অনেক পরিশ্রম করতে হবে এবং টাকা জমাতে হবে। সবুরের অবশ্য এখন আর তেমন কোনো স্বপ্ন নেই। সব ভাইয়ের কাজে সাহায্য করে যে টাকা পায় তা দিয়েই সে কোনোরকমভাবে সংসার চালিয়ে নেয়। বড়ভাই আজমলের অবশ্য অনেক সম্পত্তি। ইতোমধ্যে হজও করে এসেছেন। তিনি একেবারে কৃপণ না হলেও খুব হিসেবি। আর হিসেবি না হলে বড় হওয়া যায় না। গ্রামবাংলায় একটি প্রবাদ আছেÑ থাকতে রাইখা খাও, বেইল থাকতে বাড়ি যাও। সব ভাইয়ের সম্পত্তি সমানই ছিল। সবুর কাজলীর পেছনে ঘুরছে আর অযথা ব্যয় করেছে। তাকে স্কুলেও দেওয়া হয়েছিল। ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কিন্তু সে যখন অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে তখন কাজলীর প্রেমে পড়ে। এরপর অনেক কথা। কাজলীকে সে পায়নি। অতঃপর ভবঘুরে হয়ে যায়। বন্ধ করে দেয় পড়ালেখাও। এখনো স্কুলের শিক্ষকেরা সবুরকে দেখলে খুব আফসোস করেন। কারণ ওই সময় এরকম মেধাবী ছাত্র গ্রামাঞ্চলে কমই পাওয়া যেত।

অগ্রহায়ণ মাস। পিঁয়াজ-রসুন, ধনে, মসুর, কালোজিরা, কলইসহ সব ফসলের চাষ শেষ হলো। চারদিকে ছোট ছোট চারা গজিয়ে সবুজে ছেয়ে যাচ্ছে খেত। গ্রামের কৃষকেরা ভোর হতেই খেতের আইল দিয়ে হেঁটে সেই দৃশ্য দেখে আর মন ভরে যায়। শীতকাল না এলেও হালকা কুয়াশার সাথে কিছুটা ঠান্ডা পড়েছে। ওয়াদুদ সারাদিন খেতে ঘুরে ফসলের মাঠ দেখে। ফসলের মধ্যে কোনো ঘাস উঠলে কাঁচি দিয়ে উপড়ে ফেলে। সবুজে ভরা মাঠের অপরূপ দৃশ্য দেখে সে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরে।
একদিন রাতের বেলায় সে গায়ে পাতলা একটি কাঁথা জড়িয়ে চাঁদনীকে নিয়ে গল্প করছে। চয়ন ঘুমিয়ে মাটি হয়ে আছে। এতদিন শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেলেও এখন প্রায় অলস সময় কাটছে চাঁদনীর। তাছাড়া সামনে যখন ফসল ঘরে আনতে হবে তখন শুরু হবে আরেক যুদ্ধ। ফসল কেটে আনা, মাড়াই দেওয়া, আরও কত কত কাজ! তাই এখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে সবাই। গল্প করতে করতে একসময় চাঁদনীরও শীত শীত লাগছে। তাই সে ওয়াদুদের শরীরের সাথে ঘেঁষে বসে কাঁথাটার একটা অংশ নিজের শরীরে দিয়ে মাথাটা ওয়াদুদের বুকের ওপর রাখল।

স্বামীর প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে চাঁদনীর এতদিনের সকল কষ্ট উবে গেল। তার হৃদয় এতটা শীতল হলো যেন সে বরফের মতো গলে পড়ছে। ওয়াদুদ চাঁদনীর চুলে বিলি কাটছে। মাঝে মাঝে কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার নরম ঠোঁট দুটিও। বিলি কাটতে কাটতে একসময় ওয়াদুদ চাঁদনীকে বুকে টেনে নেয়। এই বয়সেও যে ওয়াদুদ তাকে ভালোবাসার চাদরে নিয়ে আদরে ভরিয়ে তুলছে তা ভাবতেই চাঁদনীর চোখ দুটি ভিজে যায়। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে, বিয়ের আগের রাতে বাবার ঠিক করা প্রতিষ্ঠিত বরকে রেখে সে যে একজন বেকার ছেলের সাথে পালিয়েছিল তা সার্থক হয়েছে। সেদিনের সেই দুঃসাহসিক কাজের কথা মনে করে সে একেবারে কেঁদেই দিলো। চাঁদনী খুব আবেগি মানুষ। সুখ-দুঃখ উভয় সময়েই কাঁদে। কিন্তু কেন কাঁদে তা সে নিজেও জানে না। এটা নিয়ে অনেকে তাকে কটু কথাও বলে। কিন্তু তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কাঁদলে মনে শান্তি লাগে, সকল বেদনা মুছে যায়। এটাতেই সে সন্তুষ্ট।

বরফের মতো গলতে থাকা চাঁদনী কেন আবার মোমবাতির মতো গলছে? কিছুই ভেবে পায় না ওয়াদুদ। তাই সে এক যুগ আগের ঘটনার মতো চাঁদনীকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। চাঁদনী কি আজ তাকে সেদিনের মতো ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দেবে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওয়াদুদের মনে। কিন্তু চাঁদনী আবার মোমবাতি থেকে বরফ হয়ে গেল। সে-ও ওয়াদুদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এইভাবে আজীবন তোমার বুকের উমে রাখবা তো?’
ওয়াদুদ চাঁদনীর সিক্ত কোমল ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমৃতের স্বাদ নিতে নিতে বলল, ‘জীবন যদি থাইমা না যায় তাইলে বুকের উমও কহনো শ্যাষ হইবো না।’
চাঁদনী কাঁপছে, ওয়াদুদের ভালোবাসায় সে যেন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও নাক বাজিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু এই উমে যদি অন্য কেউ বাসা বান্ধে।’
‘এই জমিন শুদু আমার চাঁদনীর জন্য, যার দিকে তাকাইয়া হাজারডা বছর কাটাইয়া দেওন যায়।’ এই বলে ওয়াদুদ আর কিছুই বলতে পারল না। শুধু ভালোবাসার আদরে চাঁদনীকে নিয়ে হারিয়ে গেল। আর চাঁদনী গলতে গলতে মিশে গেল ওয়াদুদের শরীরে।

এত সুখ কি আর প্রকৃতি সয়? ওয়াদুদ আর চাঁদনীর সুখও সইতে পারল না প্রকৃতি। সইতে পারল না গ্রামবাসীর আরামের ঘুমও। চাঁদনীর মতোই যেন কেঁদে ভাসিয়ে দিলো চারদিক। সেই রাতেই ওয়াদুদের বলদ দুটি বজ্রপাতে মারা গেল। অগ্রহায়ণ মাসে তো সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু কোথা থেকে এলো এত বৃষ্টি? প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওয়াদুদের। চাঁদনী সেই যে তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে তো ঘুমিয়েছেই, আর কোনো খবর নেই। ওয়াদুদ চাঁদনীর হাত সরিয়ে দাঁড়াতেই চাঁদনী জেগে যায়। বজ্রপাতের বিকট শব্দে ভয়ে সে আবারও ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরে। বাইরে বলদের কয়েকবার হাম্বা ডাক শোনা গেল। ওয়াদুদের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। এই বলদ দুটিই যে তার বড় সম্বল। সাথে সাথে সে চাঁদনীকে সরিয়ে দরজার সামনে যায়। এত বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে যে বাইরে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। এ সময় সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চাঁদনী, ‘বলদ মরলে আবার কেনা যাইব কিন্তু তোমারে পামু কই? এক পা-ও আর বাইরে দিবা না। তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই।’
‘আরে মাগি বলদ দুইডা মইরা গ্যালে হাল চাষ করমু কী দিয়া? তুই পথ ছাড়।’ এই বলে ওয়াদুদ চাঁদনীকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে লুঙিতে মালকোঁচা মেরে গোয়ালঘরের দিকে দৌড় দিলো।

বাইরে প্রচণ্ড অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বজ্র পড়লেই কেবল প্রত্যক্ষ করা যায়। ওয়াদুদ সবকিছু উপেক্ষা করে গোয়ালঘরে গেল। অন্ধকারে এদিক-ওদিক হাতড়াচ্ছে সে। এ সময় তার হাতে একটি বলদ পড়ল। সে বুঝতে পারল এটি আর জীবিত নেই। এরপর আরেকটি খুঁজতে লাগল কিন্তু হাতে বাজছে না। এর মধ্যে আবারও জোরে বিদ্যুৎ চমকাল। গোয়ালঘরের চাল নেই। বজ্রপাতে পুড়ে গেছে। তবে সে এবার আরেকটি বলদ ঠিকই দেখল। কিন্তু এটাও মৃত।
আকাশের মতো ওয়াদুদের চোখ দুটিও আলগা হয়ে গেল। চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গেল। সে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার এহন কী হইবো? হাল চাষ করমু কী দিয়া!’ কিন্তু বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার শব্দ মিলিয়ে যায়। সে এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথায় হাত দিয়ে গোয়ালঘরের বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এ সময় আরেকটি বজ্র গোয়ালঘরের পাশে পড়ল। এদিকে ঘরের ভেতর থেকে চিৎকারের শব্দ পাওয়া গেল। তবে আবছা আবছা। ওয়াদুদ তাড়াতাড়ি দৌড়ে ঘরে চলে গেল।

‘তোমারে বারহায় বারহায় বাইরে যাইতে না করলাম, ক্যামনে ঠাডা পড়তাছে। যদি কিছু হইয়া যাইতো তাইলে চয়ন কারে বাপ বইলা ডাক দিতো?’ শেষের কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দিয়ে থেমে গেল চাঁদনী। অন্ধকারের জন্য ওয়াদুদ অবশ্য সেটা প্রত্যক্ষ করেনি। শুধু এতটুকু বলল,
‘মরার আর বাকি রইল কী!’ চাঁদনী ওয়াদুদের শরীর গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ‘কিছুই মরে নাই। বাঁইচা আছো তাতেই অনেক কিছু। তুমি যে আমার মনের মাজে জ্বইলা থাকা আলো। তোমার ছায়া দ্যাখলেও যে পরনডা জুড়াইয়া যায়! তুমি আছো বইলাই পিথিবিটা এত সুন্দর লাগে! মন চায় তোমার মুকটার দিকে চাইয়া চাইয়া জীবনডা পার কইরা দেই। আর হেই তুমি সামান্য দুইডা বদলদের নিগ্গা ঠাডা উপেক্ষা কইরা গোয়ালঘরে চইলা গ্যালা? একবার ভাইবাও দ্যাখলা না তোমার কিছু হইয়া যাইলে এই পাগলিটার কী হইত? কার বুকে মাতা রাইখা শান্তির ঘুম দিতো? তাড়াতাড়ি লুঙ্গি পালটাও, নাইলে যে জ্বর আইয়া পড়তে পারে।’

এর মধ্যে সবুরের ঘর থেকে প্রচণ্ড কান্নার শব্দ শোনা গেল। ওয়াদুদ ভেজা লুঙ্গি নিয়েই দৌড় দিলো। সবুরের ঘরটি ছিল একেবারেই নড়বড়ে। থামগুলো ঘুণে ধরা। তাই সহজেই দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। সবুর বের হতে পারলেও তার স্ত্রী ও সন্তানেরা ভেতরে আটকা পড়েছে। বাতাসের বেগ বেড়ে ঘর নড়লে সবুরের স্ত্রী চিৎকার দিয়ে ওঠে, আবার থামলে সে-ও থেমে যায়। হয়তো তার বুক কিংবা গলার ওপরে কিছু পড়েছে। তবে বাচ্চাদের চিৎকার একটানাই চলছে।

ওয়াদুদ কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সবুরের কোনো হুঁশজ্ঞান নেই। সে যে কাঁদবে সেই শক্তিটুকুও নেই। সুতরাং এখানে তার ভূমিকা বলতে কিছুই নেই। তার ওপর বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। সবুরদের চিৎকারের শব্দ পেয়ে অন্য ভাইয়েরাও চলে এসেছে। অবশেষে সব ভাইয়েরা দা, কাঁচি ও শাবল এনে ঘরের বেড়া ও চাল খুলতে লাগল। ইতোমধ্যে তাদের সাথে পাড়া-প্রতিবেশীরাও যোগ দিয়েছে। প্রথমেই বের করা হলো সবুরের ছোট্ট মেয়েকে। সে একেবারে নিথর। এরপর একে একে দুই ছেলেকে। কিন্তু দুজনই প্রায় আধামরা। এই অবস্থা দেখে সবুর একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাসের কারণে ঠিকমতো উদ্ধারকাজ করা যাচ্ছে না। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে সবাই ঘরের এক এক অংশ খুলে যাচ্ছে। একসময় সবুরের স্ত্রীকে পাওয়া গেল। তবে তার গলার ওপর বাঁশের নরা পড়েছে। বাতাসে নরা ওপরে উঠলে সে শ্বাস নিতে পারছে; আবার নামলে শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে সবাই ধরে সেই বাঁশ উঁচু করে সবুরের স্ত্রী আকলিমাকে উদ্ধার করল। আকলিমা হাতের ইশারায় পানি খেতে চাইল। মুখে এক ঢোক পানি নিতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরুষরা শক্ত থাকলেও মহিলাদের কান্নার রোল পড়ে গেল। ততক্ষণে অবশ্য গ্রামের মানুষ এসেও জড়ো হয়ে গেছে।

কাদায় পুরো বাড়ি যেন গোয়ালঘরে পরিণত হলো। এত রাতে সবুরের স্ত্রী ও দুই ছেলের চিকিৎসা কীভাবে করাবে? এলাকায় কোনো রাস্তাঘাট নেই। তার ওপর ঝড়-বৃষ্টি। ঝড়-বৃষ্টি কিছুটা কমলে নৌকায় করে এক মাইল দূর থেকে শিবচরণ ডাক্তারকে আনা হলো। কিন্তু তিনি এসে সবার পালস পরীক্ষা করে নীরব হয়ে গেলেন। কেউ বেঁচে নেই। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। মসজিদ থেকে সুরেলা কণ্ঠে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে চারদিক ফরসা হয়ে এলো। পাটি বিছিয়ে একই সারিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে সবুরের স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়েকে। অবশ্য এখন আর তাদের কেউ নাম ধরে ডাকে না। সবার মুখেই একটি শব্দ ‘লাশ’।

সবুরের মেয়েটিকে দেখলে মনে হচ্ছে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। কী নিষ্পাপ শিশু! কেউ দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন মানুষের চোখের জলের বন্যা হচ্ছে। সবুর বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে বুক চাপড়ে বলে, ‘এহন আমার কী হইবো? হে আল্লাহ এ তুমি কী করলা? তুমি কি সরলের ওপর দিয়া গরল ঢাললা?’ পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে এই ধরনের কথা বলতে নিষেধ করছে। কিন্তু সবুরের যে প্রাণে আর সয় না। ‘হে আল্লাহ্ আমারেও ক্যান নিয়া গ্যালা না’Ñ এই বলে সে বুক চাপড়ে আবারও অজ্ঞান হয়ে গেল।

এমন রোজ কেয়ামত গ্রামবাসী আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। তাছাড়া অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। যদিও কখনো হয়েছে কিন্তু এতটা প্রকট ছিল না। সবুররা পাঁচ ভাই একসাথে বসে আছে। কারও কপালে হাত, কারও মাথায়, আবার কেউ থুতনিতে হাত ভর করে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন পাঁচ ভাইই বোবা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। একেক জন একেক দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে।

সবুর এখন মূর্ছা না গেলেও পাটিতে শুইয়ে রাখা লাশগুলোর দিকে পাথরের চোখে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে গ্রামের মোড়ল এসে সবুরের বড় ভাই আজমলকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। কারণ লাশের তো দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবুরদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। সেই মাঠেই বাদ জুম্মা জানাজা হয়। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব হলেও আজকে আর সবুরের কোনো আফসোস নেই। মাঠের কানায় কানায় মানুষে পূর্ণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। এত মানুষ কোথা থেকে ও কীভাবে এলো তা জানে না সবুর। সামনের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটি আবছা হয়ে যায় আর ভেসে ওঠে স্ত্রী-সন্তানদের ছবি।

প্রতীক্ষা পর্ব – ৩

চারদিকে রোদে খাঁ খাঁ করছে। কতগুলো পাখি উড়ে যাচ্ছে। কয়েকটি হাঁস পুকুরের জলে পাখা মেলে দৌড়াচ্ছে আর প্যাক প্যাক করছে। হালকা বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। গ্রামের এক যুবক পুকুরের দিকে মুখ করে গাছের নিচে বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। এ সময় গফুরের ছেলে রাশেদ এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়। ক্রোধে লোকটির চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে।

কিন্তু নিমেষেই সেই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে দৌড়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাশেদকে বলল, ‘এইদিকে আয়, কিছু কমু না।’
‘না, আপনি আমারে মারবেন’ এই বলে রাশেদ দৌড়ে আরেকটু সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটি একটু হেসে বলল, ‘আরে না, কিছু কমু না। তাছাড়া আমি তো এমনিতেই নাইতাম এহন।’ লোকটির কথা শুনে রাশেদ সামনে এলো। লোকটি রাশেদের হাতে পাঁচটি টাকা তুলে দিয়ে বলল,
‘এই নে, এইডা দিয়া কিছু কিন্না খাইছ। আর হোন, তোর বাহে যহন আমার মতোন মুততে বইবো তহন তারেও এইভাবে ধাক্কা দিবি। তাইলে তোরে আরও পাঁচ টাহা দিমু।’
রাশেদের মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সাথে সাথেই বলল, ‘দিবেন তো? না দিলে কিন্তু পরে আপনেরে আবার ধাক্কা দিয়া হালাই দিমু।’
‘কইলাম তো দিমু’ এই বলে লোকটি মনে মনে হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

রাশেদ নতুন পাঁচ টাকার নোট পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কখন বায়োস্কোপওয়ালা আসবে আর সে বায়োস্কোপ দেখবে, এই আশায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। বায়োস্কোপকে এলাকার সবাই টকি বলে। বর্তমান সময়ের মতো তখন টেলিভিশনের আধিক্য ছিল না। কয়েক গ্রাম ঘুরলে হয়তো এক বাড়িতে টেলিভিশন পাওয়া যেত। তাই ওই সময়ে বায়োস্কোপ ছিল বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম। তাতে জানা-অজানা, বিনোদনসহ নানা ধরনের দৃশ্য দেখানো হতো। কিছুক্ষণ যেতেই এক বায়োয়স্কোপওয়ালা তার হাতে থাকা ঘণ্টাটি বাজাতে বাজাতে ডাকতে লাগল, ‘টকি দ্যাখবে, টকি! টকি দ্যাখবে, টকি!’

রাশেদ ডাক দিয়ে বায়োস্কোপওয়ালাকে থামালো। এরপর বায়োস্কোপওয়ালা তার হাতে থাকা ঘণ্টা বাজিয়ে আবারও জোরে জোরে ডাকতে লাগল, ‘টকি দ্যাখবে, টকি…।’
বায়োস্কোপওয়ালার ঘণ্টা ও ডাক শুনে চারদিক থেকে বাচ্চারা পয়সা হাতে দৌড়ে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে তারা মৌমাছির মতো বায়োস্কোপটি ঘিরে ধরল। শুরু হলো বায়োস্কোপ দেখা। বায়োস্কোপের ভেতরে যা যা দেখানো হচ্ছে তা জোর গলায় বলতে লাগল লোকটি,
রাজার ছেলে আইয়া পড়ছে, রানি তো খেইপা আছে।
রাজায় কয় এই মাইয়া আনমু না, রাজপুত্র কয় তারে ছাড়া বিয়া করমু না।
রাজপুত্র বন্দি হইলো, প্রেমিকা বিষ খাইবার ঘোষণা দিলো।
দাসী আইসা জেলখানায় সেই খবর দেয়, পাহারাদার গোপনে মুক্তি দেয়।
রাজপুত্র যায় প্রেমিকার কাছে, না খাইয়া শুকাই গেছে।
বুকে জড়াইয়া দুজন চোখ ভাসায়, রাতের আঁধারে গোপন প্রণয়।
এই খবর গেলে রাজার কাছে, ধইরা আনার আদেশ আসে।
অতঃপর বন্দি দুজন, তাই দেখিয়া রানির ক্রন্দন।
রাজায় তা শোনে না, সৈন্যদের প্রাণ মানে না।
রাত হইলে রাজপুত্রকে দেয় ছাড়িয়া, প্রেমিকার জন্য যায় প্রাণ কাঁদিয়া।
রাজপুত্র প্রেমিকার কামরায় আইলো, দুজনের আবার মিলন হইলো।
রানি যায় সব জাইনা, অবশেষে বধূ হিসেবে নেয় মাইনা।

বায়োস্কোপ দেখা শেষ হলে রাশেদ বাইরে তাকিয়ে ঝাপসা দেখছে। হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে সে সোজা ঘরে চলে এলো। তার বয়স কম হলেও দুষ্টুমির ওস্তাদ। সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাই তার কাজ। রুমে ঢুকে সে যা দেখল এমন দৃশ্য সে কিছুক্ষণ আগে বায়োস্কোপেও দেখেছে। তার মা কল্পনা ও ছোট চাচা ফয়েজ জড়িয়ে ধরে আছে। তাকে দেখার সাথে সাথেই কল্পনা কাঁথা দিয়ে নিজের শরীর ঢাকল আর ফয়েজ লুঙ্গিটা টেনে নিয়ে শরীরে জড়াল।

এগুলো কী হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারেনি রাশেদ। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা, তুমি কি রাজপুত্র?’ ফয়েজ এমনিতেই থতমত খেয়ে আছে, তার ওপর ভাতিজার এমন প্রশ্নে আঁতকে উঠল। সাথে সাথে সে চেয়ারের ওপর রাখা জামাটা গায়ে দিয়ে পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নতুন নোট বের করে রাশেদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ক্যান, কী হইছে বাবা?’ ‘তুমি মার সাথে যেমন করছো, একটু আগে টকির মইদ্দে রাজপুত্র একটা মাইয়ার সাথে এমনই করেছে।’
ফয়েজ বুঝতে পারল রাশেদ বায়োস্কোপ দেখেছে। আর বায়োস্কোপে কী দেখায় তা সে ভালো করেই জানে। তাই সে আবার পকেট থেকে চারটি পঁচিশ পয়সার কয়েন হাতে দিয়ে বলল, ‘এইগুলা মাইনসেরে কইতে হয় না, আর কইলে কিন্তু টকি আর আইবো না।’ রাশেদ ওই পয়সাগুলো নিজের পকেটে গুঁজে বলল, ‘তাইলে আর কয়ডা পয়সা দাও, নাইলে কিন্তু খ্যালতে যাইলে সবাইরে কমু আমাগো বাইত্তে টকি দ্যাহা যায়। তহন কিন্তু সবাই ঘরে আইয়া টকি দ্যাখতে চাইবো।’ ভাতিজার কাণ্ড দেখে ফয়েজ আকাশ থেকে পড়ল। পকেট থেকে পাঁচ পয়সার পাঁচটা কয়েন বের করে রাশেদের হাতে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, তয় এইগুলা আর মাইনসেগো কইস না, তাইলে কিন্তু সবাই ঘরে আইয়া ঘর নষ্ট কইরা হালাবো।’ রাশেদ তার চাচার হাত থেকে পয়সাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। এই সুযোগে কল্পনা কাঁথার মধ্যে থেকে উঠে ফয়েজকে বাইরে যেতে বলে গায়ে কাপড় জড়াতে লাগল।

আমেনা চুলায় লাকড়ি গুঁজে তরকারি রান্না করছে। ইতোমধ্যে ভাতের মার গালানোর জন্য পাতিল মালসায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে কতকগুলো শালুক। এগুলো নিচু জমিতে জমে থাকা পানির মধ্যে থেকে উঠিয়ে এনেছে ফয়েজ। আমেনা শালুক ছিলে টুকরো টুকরো করছে। শালুকগুলো মাছের মধ্যে দেওয়া হবে। কিছু শাপলাও আছে। মাছের মধ্যে শালুক দেওয়ার পরে সে শাপলার লতাগুলো কুটছে। বিয়ের শাড়ি শরীরে না থাকলেও হাতে মেহেদির দাগ ঠিকই আছে। তরকারি কোটার সময় আস্তে আস্তে সেই দাগ উঠে যাচ্ছে। কিন্তু তার মনের কী হলো?
কী যেন চিন্তা করে নাকের ওপর শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। মুখটিও কেমন যেন মেঘলা আকাশের মতো বিবর্ণ হয়ে আসছে। শাপলাগুলো কোটা শেষ হলে আমেনা সেগুলোকে একটি মাটির পাত্রে ঢেলে ধুতে লাগল। এ সময় রাশেদ এসে তার সামনে পয়সাগুলো ফেলে বলল, ‘দ্যাখছো কাকি, আমার কতগুলা পয়সা! এইগুলা কাকায় দিছে।’
‘হ এইজন্যই তো তুমি কাকারে ছাড়া কিচ্ছু বুজো না। কাকায় খুব ভালো মানুষ, তাই না?’ এই বলে আমেনা মাটির পাত্র থেকে কাটা শাপলাগুলো ভাজি করার জন্য কড়াইতে উঠিয়ে দিলো।
‘তুমি পচা, আমারে পয়সা দাও না। আমি কাকারে কমু তোমারে বাইত্তে থেইকা খ্যাদাই দিতে।’ কথাটা শুনে আমেনা চুলায় লাকড়ি দিতে দিতেই হাসতে লাগল।

কল্পনা ইদানীং আমেনার খুব ভুল ধরছে। যেটা করতে যায় সেটাতেই নাকি ভুল হয় আমেনার। বিষয়টা সে ফয়েজকে জানালেও তাতে কান দেয়নি। বলেছে, ‘তুমি ছোট মানুষ। এহনও সবকিছু ঠিকমতো হিগো নাই, তাই এইগুলারে দোষ না ধইরা হিগো। তাছাড়া একসাথে তো আর আজীবন থাকোন যাইব না। একদিন না একদিন জুদা হইতেই হইবো। তাই কামে ভুল ধরলে তো তোমারই লাভ। সবকিছু হিগগা গ্যালা।’

স্বামীকে যে কীভাবে বোঝাবে তা বুঝতে পারছে না আমেনা। তাই তার মন চায় নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে। তারপরেও মুখ খুলে বলল, ‘তাই বইলা আমি এতটা বোকা না যে কিছুই হিগগা আহি নাই। মায় তো হারাদিন খেতের জিরাত, গরু, ছাগল আর হাঁস-মুরগি নিয়া পইড়া থাকতো। আমিই তো রান্না-বান্নাসহ সংসারের সব কাম সামলাইছি।’
‘আরে মাগি, হেইডা বাপের বাড়ি। আর এইডা হউর বাড়ি। যে তোমার ভুল ধরতাছে হ্যার বিয়ার পর হাইজ্জা ভাবি ভুল ধরত। আবার হাইজ্জা ভাবির ভুল ধরতো মাইজ্জা ভাবি, মাইজ্জা ভাবির ভুল ধরত বড় ভাবি। এহন বুজছো তো সব? বিয়ার পর হউর বাইত্তে কয়ডা দিন মরণ কামড় থাকে। একটা কতা আছে নাÑ যে সহে সে রহে। এই মরণ কামড়ডা সইয়া গ্যালে তারে আর কেউ কামড়াইতে পারে না। কামড় খাইতে খাইতে নিজেই সাপ হইয়া যায়। তাই মুক বুইজা কয়ডা দিন সইজ্জ করো। দ্যাখবা সব ঠিক হইয়া গ্যাছে।’ স্বামীর কথায় যদিও কিছুটা যুক্তি খুঁজে পেল আমেনা, তবে ‘মাগি’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা তার ভালো লাগল না। তারপরেও কী আর করার! স্বামী বলে কথা। মুখটি গোমড়া করে খাটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে বসে রইল।

ফয়েজ বারবার কী যেন চিন্তা করছে। মাঝে মাঝেই তার মুখটি মলিন হয়ে যায়। আবার মোচড় দিয়ে অন্যদিক মুখ করে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা লক্ষ করছে আমেনা। কিন্তু কিছু না বলে সে হারিকেনের আলো কমিয়ে দিলো। আধো আলোতে স্বামীর মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ফয়েজ আমেনার সামনে এসে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি আলোডা কমাই দিলা?’ আমেনা ফয়েজের হাতে একটু চাপ দিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
‘এহন কয়ডা বাজে তা কি জানো? শুদু কি মাইনসের পোলাগো হাতে পয়সা গুঁইজা দিলেই হইবো? নিজের পোলাহান লাগব না?’ কথাটা শুনে ফয়েজের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। ‘তাইলে কি কিছু জাইনা গেল আমেনা? রাশেদ কি কিছু কইছে তারে? কিন্তু কওয়ার তো কতা না। তাছাড়া ও তো এত কিছু বুজে না।’ কথাগুলো মনে মনে বলে আবার নিজের মনকে শক্ত করল ফয়েজ। এরপর আমেনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ক্যান, কী হইছে? রাশেদ তো আমাগোই পোলা।’

ফয়েজের স্পর্শে আমেনার সকল অভিযোগ দূর হয়ে গেল। বুকের মাঝে জমে থাকা বরফ গলে শীতল হয়ে গেল। এর মধ্যে সে অনুভব করল ফয়েজ কাঁপছে। ‘কিন্তু এমন তো কহনো হয়নি’ মনে মনে এই প্রশ্ন করে আমেনা ফয়েজের বুকে হাত দিয়ে বলল, ‘এ কী! তোমার বুকের মইদ্দে লাফাইতাছে ক্যান?’ আমেনা ফয়েজের স্পর্শে একেবারে নীরব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো মেয়ের মনের বিরুদ্ধে কিছু হলে তো এতটা শান্ত থাকার কথা না। তাছাড়া এগুলো জেনে গেলে শরীর স্পর্শ করলে গরুর মতো সিদা লাথি দিতো। কথাগুলো ভেবে ফয়েজ বুঝে নিলো যে আমেনা কিছুই জানে না। ‘হ, লাগব তো। বাঁইচা থাকতে যদি পোলা মাইয়া বিয়া দিয়া নাতিনাতনি না দেইখা যাই তাইলে জীবনের আর কী মূল্য থাকল।’ কথাগুলো বলতে বলতে ফয়েজ হারিকেনটি একেবারে নিভিয়ে দিয়ে আমেনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমেনা আর কিছু বলতে পারল না। অনুভূতিতে তার বুকের মধ্যেও লাফাতে লাগল।

চারদিকে সূর্যের আলো পড়ে ফরসা হয়ে আসছে। খোঁয়াড়ে আটকে রাখা হাঁসমুরগি বের হওয়ার জন্য জোরে জোরে ডাকছে। গোয়ালে রাখা গরুগুলোও হাম্বা হাম্বা করছে। কিন্তু ফয়েজ আর আমেনার কোনো খবর নেই। সেই যে ঘুমিয়েছে তো ঘুমিয়েছেই। ইতোমধ্যে রাশেদ ঘুম থেকে উঠে গেছে। এদিক ওদিক পায়চারি করে সে ফয়েজের ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। এরপর সে কিছু না বলেই মায়ের কাছে চলে যায়। ‘মা মা, কাকায় না কাকির সাথে টকি খ্যালে।’ কথাটা শুনে কল্পনা হেসে ফেলে। পরক্ষণে সেই হাসি নিয়ন্ত্রণ করে সে রাশেদের গালে একটি থাপ্পড় মেরে বলল, ‘আর যদি কহনো টকি খ্যালার কতা মুকে আনোছ, তাইলে কিন্তু একেবারে শ্যাষ কইরা দিমু।’ কথাটা বলতে যতটুকু সময় লাগল; মুহূর্তেই তার বুকের মাঝে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল। ‘না না, আমি ভুল হুনছি’ এই বলে কল্পনা একেবারে কেঁদেই দিলো।

ততক্ষণে অবশ্য রাশেদও মায়ের মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে চলে গেছে। ‘বাবা বাবা, মায় আমারে মারছে। তুমি যাইয়া মায়রে মাইরা দিবা কিন্তু!’
‘কোতায় মারছে দেহি তো।’ এই বলে গফুর রাশেদকে কোলে তুলে নিলো। রাশেদ লাফ দিয়ে কোল থেকে নেমে তাকে টানতে টানতে বলল,
‘এহনই মায়রে মাইরা দিতে হইবো, তাড়াতাড়ি নও।’ গফুর আবারও ছেলেকে কোলে টেনে নিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে চল, তোর মায়রে এহনই মাইরা দিমু। কিন্তু তোর মায় যদি মইরা যায় তহন কারে মা বইলা ডাকবি?’ কথাগুলো শুনে রাশেদ আঁতকে উঠল। তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হতে লাগল। সাথে সাথে সে জোরে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘না, আমার মায়রে মারবা না। মায় মইরা গ্যালে আমি কার কাছে থাকমু?’

প্রতীক্ষা পর্ব – ২

‘এত রাইতে কে যায় বাড়ির ওপর দিয়া?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘আর কেডা?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘আর কেডা?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘এই মিয়ারা ফাইজলামি করার আর জায়গা পাও না, তাই না? এই চাঁদনী হারিকেনডা নিয়া আয় তো, কোন বাপের বেডারা যায় মুক কয়ডা একটু দেইখা রাহি।’

জয়নুদ্দিন সর্দারের বয়স এখন আশির কোঠায়। ছেলে হয় না বলে একে একে তিনি আট মেয়ের জনক। চাঁদনী বাদে সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি ধবধবে ফরসা। আর তার স্ত্রী কালো হলেও চেহারার ধরন ছিল অত্যন্ত মনোহারিণী। চাঁদনী তার বাবা-মা উভয়েরই গড়ন পেয়েছে। শরীরের বর্ণ পেয়েছে বাবারটা আর চেহারার ধরন পেয়েছে মায়েরটা। সুতরাং তার ষোলোকলাই পূর্ণ হয়েছে। এত সুন্দর বলে এলাকার সবাই চাঁদের সাথে নাম মিলিয়ে তাকে চাঁদনী নামেই ডাকতে শুরু করে। তাতে একসময় তার নাম হয়ে যায় চাঁদনী। তার বিয়ের জন্য বহু সম্বন্ধ এলেও বিয়ে দেননি জয়নুদ্দিন সর্দার। একে তো সবার ছোট, তার ওপর স্ত্রী মারা গেছেন। মেয়েকে বিয়ে দিলে একেবারেই একা হয়ে যাবেন। অন্য মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে দেখে গেলেও এই চাঁদনীকে নিয়েই থাকছেন তিনি।

চাঁদনী হারিকেন নিয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। হারিকেনের আলো চাঁদনীর চেহারায় পড়ে দুধের মতো সাদা চামড়া ঝকঝক করছে। আর সেই দৃশ্য দেখে ওয়াদুদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। চিন্তা করল এই বুড়াকে খ্যাপানো যাবে না। তাই সে জয়নুদ্দিন সর্দারের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলল, ‘মাফ করবেন সর্দার সাব।’ এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াদুদকে চিনতে পেরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কে?’ পরিচিত ওয়াদুদ উত্তরে বলল, ‘ওয়াদুদ।’ জয়নুদ্দিন সর্দার একটু বিরক্তির স্বরে আবার বললেন,
‘তাইলে তোমার পাশে থাকা আরেকজন কে?’ ‘ইনিও ওয়াদুদ।’ জয়নুদ্দিন সর্দার লাঠিতে ভর করে হাঁটেন। রাগে হাতে থাকা সেই লাঠিটি দিয়ে তার পরিচিত ওয়াদুদকে বাড়ি দিতে গেলেন। এ সময় ক্ষমা চাওয়া ওয়াদুদ সেটা ফেরাতে গেলে তার হাতে বাড়ি লেগে হাত কেটে যায়।

কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি তিনি। ক্ষমা চাওয়া ওয়াদুদকে ঠেলে দিয়ে আবারও বাড়ি দিতে গেলে চাঁদনী এসে ‘এ কী করতাছেন বাবা’ বলে লাঠিটি ধরতে যায়। একই সময়ে ওয়াদুদও লাঠি ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এর আগেই পায়ে লেগে হারিকেনটি উলটে পড়ে নিভে যায়। অন্ধকারে কারও কোনো খেয়াল নেই। ফলে ওয়াদুদের হাতে লাঠি না পড়ে, পড়ে চাঁদনীর হাতে। ওয়াদুদ জয়নুদ্দিন সর্দারকে ভেবে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দয়া কইরা থামেন সর্দার সাব।’ চাঁদনী এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেল। ফলে অনুভূতিতে তার শরীর কেঁপে উঠল। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে ওয়াদুদকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে হারিকেনটি খুঁজতে লাগল।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। চেয়ারম্যান-মেম্বারের লোকেরা ভোট চাইতে জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। তিন গ্রামের তিন ওয়াদুদ। একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই আর বাকি দুজন তাদের নির্বাচনি কর্মী। তিনজনেরই একই দল ও একই নামের হওয়ায় ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তারা একে অন্যকে ‘মিতা’ বলে ডাকে। যেখানে ভোট চাইতে যায় তিনজনে একই সাথে যায়। এর অবশ্য একটি বড় কারণও আছে। গ্রামাঞ্চলে মানুষ সাধারণত রাতের বেলায় ভোট চাইতে বেশি যায়। যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকেরা দেখতে না পারে। রাতের বেলায় অন্ধকারে ভোট চাইতে গেলে সবাই জিজ্ঞেস করেÑ কে যায়? এতে তারা তিনবার একই নাম বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আবার কেউ রেগে গেলেও পরিচয় দিলে কিংবা আলোতে গেলে চিনতে পারলে আর কিছুই বলে না। একদিকে ভোট চাওয়া হয়, আবার অন্যদিকে তারা আনন্দও পায়।

চাঁদনী সেদিন ঘরে ফিরে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার কাছে মনে হচ্ছিল ওয়াদুদ তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওয়াদুদের শরীরের গন্ধ তার নাকে আসছে, শরীরের ওম তার শরীরে লেগে আছে। সবকিছু মিলিয়ে চাঁদনীর হৃদয় কুটিরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারবার ঘুমাতে চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না। কারণ ওয়াদুদের প্রেতাত্মা যে তাকে আছর করে রেখেছে। আট বছর আগের কথা মনে করে তার শরীরে সেই অনুভূতি হচ্ছে। যদিও সে এখন ওয়াদুদের ঘরনি কিন্তু তারা যে এখন আর এক বিছানায় ঘুমায় না। চাঁদনীর মন চাচ্ছে সেদিনের মতো ওয়াদুদ এসে তাকে জড়িয়ে ধরুক, হৃদয়ের সকল রাগ-অভিমান ভাঙিয়ে দিক। যদিও এই আট বছরের দাম্পত্য জীবনের হিসেবে সেদিনের কয়েক সেকেন্ডের অনুভূতি কিছুই না। কিন্তু চাঁদনীর কাছে তা এখনো লক্ষ কোটি গুণ বেশি। কারণ ওই দিনের অনুভূতিই ছিল ওয়াদুদের প্রেমে পড়ার মূল কারণ।

আট বছর পেরিয়ে গেলেও চাঁদনীর কোনো সন্তান হচ্ছে না। কিন্তু দোষ কার? স্বামীর, না তার? উত্তরটা কারো জানা না থাকলেও চাঁদনীর ঘাড়েই এসে পড়েছে দোষটা। ওয়াদুদ যদিও মুখ ফোটে কখনো বলেনি, তবে তার পরিবারের এ নিয়ে মাথা ব্যথার কোনো অন্ত নেই। তারা তাকে আবারও বিয়ে করার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ওয়াদুদ কী করে আবার বিয়ে করবে? চাঁদনীকে পাওয়া যে তার কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই ছিল। অনেক যুদ্ধ করেই তাকে পেতে হয়েছিল। ভোট চাইতে যাওয়ার দিন অনুভূতি কি শুধু চাঁদনীরই হয়েছিল? মোটেও নয়। ওয়াদুদও সেদিন বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারেনি। চাঁদনীর মতো তারও মনে হতো সে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরে আছে।

সেই পুরনো কথা মনে করে আজ চাঁদনীর চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কাছে সে একজন ‘বাজা’ মেয়ে হিসেবে পরিচিত। মনে হচ্ছে যেন সে এক কলঙ্কিনী। কিন্তু এই কলঙ্ক নিয়ে তার আর দুনিয়াতে বাস করতে মন চায় না। অবশ্য ওয়াদুদও থেমে থাকেনি। ডাক্তার, ফকির, বৈদ্য যে যার কথা বলেছে সেখানে নিয়েই চাঁদনীর চিকিৎসা করিয়েছে। সর্বশেষ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কদম আলী বাবার দরবারে। অনেকে তাকে ‘কদম ফকির’ বলেও ডাকেন। মূলত চাঁদনী এই ফকিরের কাছে যেতে চায় না বলেই ওয়াদুদ বিছানায় মুখ ফিরিয়ে থাকে। কদম আলী বাবা তাকে এক সপ্তাহ তার আস্তানায় রেখে চিকিৎসার কথা বলেন। বাবার বড় বড় চোখের চাহনিতে চাঁদনীর খুব ভয় হয়। কিন্তু ওয়াদুদের অনুরোধে সেখানে থাকতে বাধ্য হয় সে।

এরপরের ঘটনা সবারই জানা। চাঁদনীর চিকিৎসার পরে কদম আলী বাবার নাম হয়ে যায় ‘সন্তান বাবা’। কারণ তার কাছ থেকে আসার পরেই চাঁদনীর গর্ভে সন্তান আসে। দশ মাস দশদিন পরে সে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে। ফলে একদিকে শ্বশুরবাড়িতে চাঁদনীর আদর বেড়ে যায়, অন্যদিকে এই খবর শোনার পরে এলাকার যে মেয়েদের সন্তান হয় না তাদের ভিড় বেড়ে যায়। বাকিদের সন্তান হোক বা না হোক চাঁদনীর সন্তানের কারণে ‘সন্তান বাবা’ বা ‘সন্তান বাবার দরবার’ নামটা বেশ পরিচিতি লাভ করে। কদম আলী বাবা ওরফে সন্তান বাবা প্রতি বছর ওরস বা সিন্নি করেন। ওয়াদুদের সন্তান হওয়ার পর থেকে সে প্রতি বছর সিন্নিতে বড় একটি অঙ্ক প্রদান করে। এ নিয়ে চাঁদনীর বড় ধরনের আপত্তি থাকলেও তা কখনো মাথায় নেয়নি ওয়াদুদ। কিন্তু যার কারণে সে ‘বাজা’ মেয়ে থেকে রত্নগর্ভার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রতি কেন এত বিমুখতা? এই কথাটা কেউ কখনো জানতে চায়নি। কষ্ট তো সবার জীবনেই কম-বেশি থাকে। আবার সুখের আড়ালেও কিছু কষ্ট থাকে। কষ্টের আড়ালের কষ্টের কথা সবাই জানে। তবে সুখের আড়ালে যেই কষ্ট থাকে তা কেউ জানে না বা জানার চেষ্টাও করে না। কারণ বাতির নিচে থাকে অন্ধকার।

চাঁদনী চয়নকে স্তন্য পান করাচ্ছে। হঠাৎ ওয়াদুদ রুমে প্রবেশ করে। সাথে সাথে সে তার স্তনটি কাপড়ের ভেতরে ঢুকিয়ে চয়নকে কোলে নিয়ে বসে রইল। মায়ের দুধ না পেয়ে চয়ন কান্না করতে লাগল। বিষয়টা বুঝতে পেরে ওয়াদুদ আবার বাইরে চলে যায়। যেহেতু প্রথম সন্তান তাই সে মানুষের সামনে স্তন্য পান করাতে এখনো লজ্জা পায়। এমনকি স্বামীর সামনেও।

বিষয়টা হাস্যকর হলেও চাঁদনীর বেলায় এটাই হচ্ছে। তবে নাতির কান্না শুনে শাশুড়ি সুফিয়া বেগম এসে দরজার সামনে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘ও বউ, বাচ্চাডা কান্দে ক্যান?’ এ সময় চয়ন আবারও কান্না করতে লাগল। তিনি বিষয়টা বুঝতে না পেরে কাছে গিয়ে আবার বললেন, ‘খিদা লাগছে মনে হয়, ওরে বুকের দুধ খাওয়াও।’ এরপর চাঁদনী তার সন্তানকে আবারও স্তন্য পান করাতে লাগল। এভাবে আস্তে আস্তে সে লজ্জা ভেঙে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। সন্তান জন্মের পরে চাঁদনী ও তার সন্তানের প্রতি শাশুড়ির আদর বেড়ে গেলেও তা আর বেশিদিন টিকেনি। কারণ এর কিছুদিন যেতেই সুফিয়া বেগম দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন।

এরপর আরও চার বছর কেটে গেলেও চাঁদনী সেই পুরনো কথা ভুলতে পারে না। ভুলবেই-বা কী করে? এইসব কারণেই তো তাকে কদম আলী বাবার দরবারে দ্বারস্থ হতে বাধ্য করেছিল। পাশের বাড়ির এক মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা। ওই সময় এসএসসি পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীরা পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে দোয়া চাইতে যেত। অবশ্য দোয়ার পাশাপাশি কিছু টাকাকড়িও পাওয়া যেত। মুরব্বিরা কয়টা পয়সা হাতে গুঁজে দিয়ে বলতÑ মা কিংবা বাবা কিছু খাইয়ো।

এই যে সামান্য কিছু টাকা তখন যে কতটা তৃপ্তি দিতো তা বলার মতো নয়। তাছাড়া তখন এলাকায় তেমন কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। এক মাসের জন্য থানা শহরে থাকতে হতো। হাঁড়ি-পাতিল, চাল, ডাল, তেল, নুন, এমনকি লাকড়িসহ ভ্যান ভাড়া করে নিয়ে যেত। পরীক্ষা কেন্দ্রের আশেপাশের কোনো বাড়ির বারান্দা কিংবা ভাড়া দেওয়ার জন্য বানানো ছোট ছোট টিনের ছাপড়ায় ভাড়া থাকতে হতো। পরীক্ষা দেওয়ার আগে মেয়েটি আশেপাশের সব বাড়ি গিয়ে দোয়া চাইল কিন্তু এলো না চাঁদনীর ঘরে। কারণ চাঁদনী বাজা মেয়ে। তার সামনে দিয়ে গেলে পরীক্ষা খারাপ হবে। বিষয়টা দেখে চাঁদনীর সেদিন মন চেয়েছিল নিজেকে শেষ করে দিতে। সে মেয়েটির জন্য কয়টা পয়সাও আঁচলে বেঁধে রেখেছিল। সেদিন রাতে সে এটা নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে অনেক কান্নাকাটিও করেছিল। তবে তার কাছে দোয়া না চাইলেও মেয়েটির জন্য মন খুলে দোয়া করতে একবিন্দুও কার্পণ্য করেনি সে।

কার্তিক মাস। পানি কমে নদীতে চলে গেছে। খেতের মাটি শুকিয়ে ফেটে ফেটে চাষযোগ্য হয়েছে। লাঙল জোয়াল নিয়ে মাঠে নেমেছে ওয়াদুদ। তার দুটি বলদ আছে। এগুলো দিয়ে সে খেত চাষ করে। এলাকায় ইঞ্জিনচালিত পাওয়ার টিলার কেবল দুই একটা আসা শুরু হয়েছে। তাও যাদের টাকাপয়সা বেশি তাদের। ওয়াদুদের ভরসা অবশ্য এই বলদ দুটিই। রসুন-পিঁয়াজ রোপণের ধুম পড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির মহিলা ও শিশুদেরও দম নেওয়ার সময় নেই। রসুনের প্রতিটি কোয়া আলাদা করে নষ্ট কোয়াগুলো ফেলে দিতে হয়। এরপর কুলা দিয়ে ঝেড়ে তা পরিষ্কার করতে হয়। ভালো কোয়াগুলো রোপণের জন্য খেতে পাঠায়। আবার পিঁয়াজের ক্ষেত্রেও নষ্ট পিঁয়াজ ফেলে ভালো পিঁয়াজগুলো বাছাই করতে হয়। এটা নিয়ে চাঁদনীর আর কাজের শেষ নেই।

দুপুর তিনটা বেজে গেছে। ওয়াদুদ এখনো ভাত খেতে আসেনি। স্বামী ভাত খায়নি বলে চাঁদনীও মুখে ভাত নেয়নি। তাই সে ভাত ও তরকারি গামলায় ভরে প্লেটসহ গামছায় বেঁধে মাঠে চলে যায়। ওয়াদুদ হাল বাইতে বাইতে ঘামে একেবারে নেয়ে গেছে। সেই দৃশ্য দেখে চাঁদনীর বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। খেতের পাশে গামছা দিয়ে বাঁধা ভাত-তরকারি রেখে সে ওয়াদুদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওয়াদুদের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ‘যাহ… যাহ…’ বলে লাঠি দিয়ে বলদ দুটিকে বাড়ি দিচ্ছে আর এগুলো দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ একটি বলদ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। এ সময় সে বলদটিকে বাড়ি দিয়ে ওঠাতে যেতেই পেছন থেকে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেল,

‘এই হুনছো? ঐ বোবা জাতরে পিডাইতাছো ক্যান? ওগো বুঝি জিরাইতে হয় না!’ ওয়াদুদ সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আইলের ওপর গামছা দিয়ে বাঁধা খাবার। সাথে সাথে সে লাঠিটি রেখে দিয়ে চাঁদনীর সামনে এসে দাঁড়াল। চাঁদনীর চোখ দুটি ভেজা। আদিগন্ত প্রচণ্ড রোদ। চোখের ওপর সেই রোদ পড়ে চিকচিক করছে। ওয়াদুদের বুকের মাঝে হু হু করে উঠল। নিশ্চয়ই বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। চাঁদনী ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরতে গেল কিন্তু ওয়াদুদ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি ঘামে ভিইজ্জা গেছি। তোমার কাপুড় নষ্ট হইয়া যাইব।’ চাঁদনী সেই বাধা উপেক্ষা করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘না হয় আমরা আরেকটু কম খাইলাম, একটু খারাপ কাপুড়-চুপুড় পরলাম; তাই বইলা এত কষ্ট করতে হইবো ক্যান?’

‘এই খেতের মইদ্দে মাইন্সে দ্যাখলে কী কইবো চাঁদনী? যাও, তুমি বাড়ি চইলা যাও। আমি কাম সাইরা বলদ লাঙল নিয়া চইলা আমুনে।’
‘না, তোমারে না নিয়া আমি যামু না।’

‘ঠিক আছে, তয় এহন আমারে ছাইড়া দাও। মাইন্সে দ্যাখলে কইবো ওগো কোনো লজ্জাশরম নাই। দিনদুপুরে ক্যামনে মাইয়া পোলারে জড়াইয়া ধইরা আছে।’
‘কউক, যার যা খুশি কউক। আমরা তো আর পর কেউ না। জামাই বউ-ই তো।’
‘ঠিক আছে, তয় এহন তুমি আইলে বহো। আমি আরেকটু চাষ দিয়া আইতাছি।
‘না, আগে খাইয়া লও। তারপর কাম।’

আইলের মাঝে দূর্বা ঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে ভাত বাড়ল চাঁদনী। এ সময় ওয়াদুদ দেখলÑ একটি নয়, দুটি প্লেট। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘থালা দুইডা ক্যান?’ চাঁদনী মুখে একটু হাসি এনে চাতকের মতো ওয়াদুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমনিতেই আনছি।’ এবার ওয়াদুদ লক্ষ করল চাঁদনীর চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে। তাই সে সাথে সাথেই বলল, ‘হায় হায়, তুমিও খাও নাই?’ চাঁদনী অবশ্য মুখে কিছু না বললেও মাথা নাড়ল। বিষয়টা দেখে চাঁদনীর প্রতি ওয়াদুদের ভালোবাসা যেন উথলে পড়ল। সে তার থালা থেকে এক লোকমা ভাত চাঁদনীর মুখে তুলে দিয়ে বলল,

‘চাঁদনী, আমি যে তোমার কাছে চিরঋণী হইয়া গেলাম।’ চাঁদনীও নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত ওয়াদুদের মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই যে তোমার গতরের ঘাম, এই ঘামের ঋণ কি কহনো শোধ করা যায়? হোনো, ভালোবাসার কোনো ঋণ থাকে না, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাইসা যাওয়াই হইছে ভালোবাসার কাজ।’ কথাটা শুনে ওয়াদুদ আর কোনো কথা বলতে পারল না। শুধু সিক্ত চোখে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রতীক্ষা পর্ব -১

দুপুরের তীব্র রোদে উত্তপ্ত চারদিক। গরম থেকে বাঁচতে কেউ কেউ গায়ের কাপড় হাতে নিয়ে চলছে। সবুরের হাতে জামা ও স্যান্ডেল। সূর্যের চোখ রাঙানির কারণে সে মাথা নিচু করে হাঁটছে। অন্যদিকে মনোযোগ নেই তার। হঠাৎ কে যেন বলল, ‘পেরুন আর স্যান্ডেল হাতে নিয়া কই যাও সবুর?’ আচমকা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে সবুর কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু ওপরের দিকে চোখ তুলতেই তার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মেয়েটি তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন উত্তর না পাওয়ায় সে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। সবুর বিস্ময় কাটিয়ে বলল, ‘আমাগো ফয়েজের বিয়া, তাই বরযাত্রী যাইতাছি।’
‘তয় এইগুলা হাতে নিয়া যাও ক্যান?’ এই বলে কাজলী সবুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কাজলীর বুকে উথাল-পাতাল খেলছে। চোখ দুটি আলগা হয়ে গেল। কয়েক ফোঁটা জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সেদিকে খেয়াল না করে সবুর পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলো। কাজলী দৌড়ে সবুরকে থামিয়ে বলল, ‘না হয় তোমার ঘরনি হই নাই, তাই বইলা কি আমি ফয়েজের বিয়ায় দাওয়াত পাইতে পারি না?’
‘আমারই দাওয়াতের ঠিক নাই, তয় তোমারে ক্যামনে দাওয়াত দিমু? তুমিই কও কাজলী, গরিব মাইনসের কি কোনো দাম আছে?’ এই বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সবুর। তাতে কাজলীর বুকের মাঝের হাহাকার আরও বেড়ে গেল। আঁচল থেকে কয়টা টাকা বের করে সবুরের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে যাও, তয় এই টাহাগুলা দিয়া একটা পেরুন আর স্যান্ডেল কিন্না নিও।’ সবুর টাকা নিতে চাইল না কিন্তু কাজলী জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলো। সবুর এবার সিক্ত চোখে কাজলীর চোখের দিকে তাকাল।

দুই সন্তানের জননী হলেও কাজলীর চেহারা আগের মতোই আছে। সেই টানা টানা চোখ, মায়াবী মুখ, গোলাপের পাপড়ির মতো রাঙা ঠোঁট! অথচ সবুরের চোখ-মুখ গর্তে ঢুকে গেছে। সবুর হারিয়ে গেল পুরনো দিনে। মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখে আবছা দেখছে সে। মনে হচ্ছে যেন তার সামনে সেই তেরো-চৌদ্দ বছরের টগবগে কাজলীই দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে সাথে সাথে কাজলীকে জড়িয়ে ধরতে গেল। কিন্তু কাজলী নিজেকে একটু পেছনে সরিয়ে নিলো। আর তাতে সবুর মাটিতে পড়ে গেল। কাজলী সবুরের দু হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, ‘শিগগির হাঁটা দাও সবুর’। সবুর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া জামা ও স্যান্ডেল উঠিয়ে জামাটি ঝাড়তে ঝাড়তে জোর পায়ে হাঁটতে লাগল। আর কাজলী সেই দৃশ্য দেখে আঁচল দিয়ে ভেজা চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরল।

সবুররা পাঁচ ভাই। তাদের মধ্যে সে তৃতীয় কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে সবার নিচে। তাই সে একসময় খুব আফসোস করে বলত, ‘আমারে ক্যান করিম চৌধুরীর ঘরে জন্ম দিলো না আল্লায়? তাইলে তো আর না খাইয়া থাকতে হইতো না।’ করিম চৌধুরীর বাড়ি পাশের গ্রামে। তার অনেক সম্পত্তি। আর ওই সম্পত্তি দেখেই সবুরের এত আক্ষেপ।
আজ তার একেবারে ছোট ভাই ফয়েজের বিয়ে। ভাইয়ের বিয়ে হলেও গায়ে জড়ানোর মতো ভালো কোনো পোশাক তার নেই। একটা জামা আছে কোনো রকম। তাও আবার কয়েক জায়গায় তালি দেওয়া। স্যান্ডেল জোড়া যে সে কতবার মুচির কাছ থেকে ঠিক করিয়ে এনেছে তারও কোনো ঠিক নেই। সে এই জামা ও স্যান্ডেল পরে না বললেই চলে। যদি কোথাও বেড়াতে যেতে হয় তখন পরে। তাও যাওয়ার সময় জামাটি কাঁধে আর স্যান্ডেলটি হাতে নিয়ে যায়। যখন গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন গায়ে জড়ায়। এরপর সেখান থেকে ফেরার সময় তা খুলে আবার হাতে নেয়। এই হলো তার অবস্থা। আজ আপন ভাইয়ের বিয়েতেও সে একই কাজ করছে।
‘ওহই ওহই পালকি বউ নিয়া আইছি’Ñ এই বলে চার বেহারা পালকিটি ঝুলাচ্ছে আর প্রত্যেক ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। এর অর্থ হলো ‘ভালো মাসাত’ দিতে হবে। ফয়েজ তার নোয়াভাই গফুর অর্থাৎ চতুর্থ ভাইয়ের সাথে থাকে। একসময় পাঁচ ভাই একসাথে থাকলেও বিয়ে করে বড় তিন ভাই আলাদা হয়ে যায়। ওই তিন ভাইয়ের ঘর থেকে টাকা উঠিয়ে পালকিওয়ালারা গফুরের ঘরের সামনে পালকি রাখল।

বড় ভাই হিসেবে অন্য তিন ভাইয়ের দায়িত্ব থাকলেও যেহেতু ফয়েজ গফুরের সাথে খায় তাই মূল দায়িত্বটা মূলত গফুরের স্ত্রী কল্পনারই। কিন্তু কল্পনার কেন যেন আজ মন ভালো নেই। কেন ভালো নেই তা এই বাড়ির কারও অজানা নয়। তবে কল্পনা কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে নতুন বউকে বরণ করার জন্য যা যা করার সবই করছে। পালকি থেকে নতুন বউকে নামাতে নামাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হারিকেনের আলোতে বউয়ের চেহারা ততটা বোঝা যাচ্ছে না।

নতুন বউয়ের নাম আমেনা। তাকে একটি পাটার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সামনে একটি কুলা। তার মধ্যে কিছু দূর্বা ঘাস, কয়টা ধান, সরিষা, কাঁচা হলুদসহ অনেক জিনিস। গ্রামের বধূরা শুরু করল বিয়ের গীত। এদিকে একটি হুলুস্থূল কাণ্ডও ঘটে গেল। বউয়ের ধৈর্য পরীক্ষার জন্য সবাই তাকে চিমটি দিতে লাগল। চারদিকে থেকে সবাই এতই অত্যাচার করতে লাগল যে আমেনা কখনো এদিক ঘোরে আবার কখনো ওদিক ঘোরে। কিন্তু যেদিকই ঘুরুক না কেন, কোনো দিক থেকেই রক্ষা নেই। এমনকি তার স্তনে হাত দিতেও কার্পণ্য করেনি আশেপাশের দুষ্টু ছেলেরা।

নতুন বউ, তাই শরীরের ওপর দিয়ে যত কিছুই যাক না কেন, মুখ ফোটে কিছু বলা যাবে না। এরকম অবস্থা দেখে বাড়ির মুরব্বিরা এসে রাগারাগি করে সবাইকে দূরে সরিয়ে দেন। এরপর বাড়ির বউ-ঝিরা কুলার মধ্যে থাকা সবকিছু আমেনার পুরো শরীরে ছিটিয়ে দিয়ে গীত গাইতে গাইতে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়।

রাত একটা। বাসরঘরে নীরবে বসে আছে আমেনা। ফয়েজ এসে তার পাশে বসল। আমেনার শরীর কাঁপছে। কিন্তু কেন কাঁপছে সে নিজেও জানে না। তাছাড়া ধৈর্যের পরীক্ষায় সে পাস করলেও দুষ্টুদের নখের আঁচড়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিলে গিয়ে জ্বলছে। স্ত্রীর ওপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা ফয়েজও দেখেছে। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। এটা যে এই অঞ্চলের রীতি। রীতি যখন প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায় তখন কার সাধ্য আছে তা ভাঙার? ফয়েজের বেলাতেও তাই হয়েছে।
অবশেষে ফয়েজ আমেনার কাঁধে হাত রাখল। এই প্রথম কোনো পুরুষের হাত তার কাঁধ ছুঁল। শরীরে যেন ইলেকট্রিকের শক লাগল। পুরো শরীর নেচে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বউয়ের চোখে জল দেখে ফয়েজের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। ‘তাহলে কি আমেনা বিয়াতে রাজি ছিল না?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিলো আমেনাই। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘বউ মরলে তাতে আর কী আসে যায়? পুরুষমানুষ আবার নতুন কাউরে পাইবে।’ আমেনা যে কথাটা অনেকটা অভিমানেই বলেছে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারল ফয়েজ। তাই সে সাথে সাথেই আমেনাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। স্বামীর স্পর্শে আমেনার মুখে জমে থাকা সকল অভিমান কর্পূরের মতো উবে গেল। স্নিগ্ধ সফেদ মুখটিতে ফোটে উঠল এক চিলতে হাসি। কিন্তু নিমেষেই তা বিলীন করে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শরীলে অনেক ব্যতা, হাত দিও না।’

‘কোতায় ব্যতা দেহি তো’। এই বলে ফয়েজ আমেনার শরীরের আচ্ছাদন খুলে দিতেই আমেনা বলল, ‘আমার বুঝি শরম করে না?’ ‘শরম’ এই বলে ফয়েজ আমেনাকে শক্ত হাতে বাহুবন্দি করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমেনা প্রচণ্ড কাশতে লাগল, সাথে ফয়েজও।
বাইরে থেকে প্রচণ্ড হাসি-তামাশার শব্দ কানে আসছে। কিন্তু তারা কেন এমন করছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না আমেনা। এর মধ্যে ফয়েজ বিছানা থেকে উঠে চারদিকে কী যেন খুঁজতে লাগল। আমেনা তড়িঘড়ি করে নিজের কাপড় ঠিক করছে। হঠাৎ ফয়েজ একটি জ্বলন্ত শুকনো মরিচের বাসন হাতে নিয়ে তার সামনে ধরে বলল, ‘পাইছি।’ আমেনা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে কিন্তু তার আগেই পোড়া মরিচের ঝাঁজে সে আরও জোরে জোরে কাশতে লাগল। এরপর ফয়েজ জ্বলতে থাকা মরিচের বাসনটির মধ্যে এক মগ পানি ঢেলে সেটিকে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। আর এ সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলো খলখল করে হাসতে লাগল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমেনা গোসল সেরে রান্নাঘরে গেলে গফুরের স্ত্রী কল্পনার বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। এই প্রথম সে আমেনাকে ভালোভাবে দেখল। আমেনার চেহারা যে এত সুন্দর তা সে কল্পনাই করতে পারেনি। কল্পনা আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন ভেবে স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘বহো বউ।’ কিন্তু কম্পমান ঠোঁটে কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। তারপরেও আমেনা বুঝতে পারল কী বলেছে সে।

আমেনা পিঁড়িতে বসে ভাত রান্না করছে। বিয়েবাড়ি, তাই আগে থেকেই বাঁশ ও গাছের ডাল কেটে শুকিয়ে লাকড়ি বানানো হয়েছে। ফলে আগুনে খুব ঝাঁজ। কিন্তু কল্পনার কী হলো? তার বুকের মধ্যে পুড়ছে কেন? কিছু না বলেই সে আমেনাকে রেখে বের হয়ে গেল। ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে বিমর্ষ মুখে আবারও রান্নাঘরে ফিরল।

আগুনের আঁচে আমেনার মুখটি ঘেমে শিশিরের মতো জল জমে গেছে। আঁচল দিয়ে সেই জল মুছতে মুছতে তার চোখ পড়ল কল্পনার চোখের ওপর। ‘চোক মুক ফুলা ক্যান? আর আমারে রাইখা কিছু না বইলা হঠাৎ কই গেছিল?’ মনে মনে কথাটি বলতেই ভাতের পাতিলের পানিতে বলক উঠে ওপরে রাখা ঢাকনাটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সাথে সাথে সে ওড়ুন দিয়ে কয়েকটি ভাত উঠিয়ে টিপে দেখল মাড় গালার সময় হয়ে গেছে। চুলায় গোঁজা লাকড়ি ওপরে উঠিয়ে আমেনা বলল, ‘ভাবি ভাত গড় দিতে হইবো। ওড়ুন নিয়া ডহি সাজান।’

‘এইগুলাও তোমার মায় তোমারে হিগায় নাই!’ এই বলে কল্পনা মালসার ওপর ওড়ুনটি রেখে ভাতের পাতিলটি এনে তার ওপর বসিয়ে দিলো। তবে তার বলা কথাটি আমেনার কানে এখনো ঠনঠন করছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না তার জা কেন এমন করছে। সে মনে মনে বলল, ‘ভাবি নিশ্চয়ই ফয়েজকে বিয়া করাইতে চায় নাই। দুইজনের সম্পত্তি একসাথে আছে। এহন ভাগ হইয়া যাইতে পারে। এই আশঙ্কাতেই হয়তো এমন করতাছে।’ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘরে চলে গেল।

হোটেল আল সালাদিয়া

মেয়েটি খুব ভালো রান্না পারে। দেখতেও অনেক সুন্দরী। বাবা চরম বিপদে পড়ে যায়। লেখাপড়া বন্ধ হয়। অতপর একটি হোটেলে কাজ নেয়- ভর্তাবাড়ি। কিন্তু সেই রান্নার সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

একদিন এক বড়লোক এসে তার রান্না খেয়ে থ হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে বউকে গালি দেয়। কাজের মেয়েদেরও গালি দেয়। এরপর সে নিয়মিত ঐ হোটেলে এসে খায়। আস্তে আস্তে তাদের প্রেম হয়। বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যায়। আগের স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেয়। সাথে কাজের মেয়েদেরও। কিন্তু বিয়ের পরে স্বামীর বাড়িতে তার রান্না ভালো হয় না।

ফলে শুরু হয় দ্বন্দ। মেয়েটি গর্ভবর্তী হয়। চাপ দেওয়া হয় এবোরশনের। কিন্তু সে রাজী হয় না। অতপর সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটিকে মেরে ফেলবে। মেয়েটিকে মেরে সে নদীর মাঝে ফেলে যায়। আর বলে বেড়ায় মেয়েটি অন্য কারো সাথে পালিয়েছে। মেয়েটি বেঁচে যায় বেঁচে যায় বাচ্চাটিও। এরপর সে আগের বউকে আবার ঘরে তুলে সাথে আগের কাজের মেয়েদেরও। অনেক বছর পর একদিন সে অন্য এক হোটেলের (হোটেল আল সালাদিয়া) কাছে যায় ক্ষুধা লাগে। ভাত খায়। কিন্তু সেই আগের মতোই স্বাদ। ছেলেটি অবাক হয়ে রান্না ঘরে যায়। গিয়ে দেখে সেই মেয়েটি একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে রান্না করছে। আবারও তার এই রান্না খাওয়ার শখ জাগল।

মেয়েটিকে আবারও নিতে চাইল কিন্তু সে রাজী হলো না। বাচ্চাটি এত সুন্দর কর মা ডাকছিল যে ছেলেটির আর প্রাণে সয় না। তারও মন চাইলো ওর বাবা ডাক শুনতে। কিন্তু সে বাবা ডাকে না। এখন কি উপায়। অবশেষে সে এই হোটেলের জায়গা কিনে নেওয়ার চিন্তা করল। কিনেও নেয়। (বাচ্চাটির নামে হোটেলটি কেনা হয়) মেয়েটি নিয়মিত ভাড়া দেয়। তবে কার নামে হোটেল তা গোপন থাকে। ছেলেটি অনেক চেষ্টা করে কিন্তু মেয়েটি রাজী হয় না। এক সময় ছেলেটি পাগল হয়ে যায়। ভবগুড়ে। নগ্ন সরীরেই ঘোরে। অনেক বছর পরে । বুড়ো বয়সে। রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে।

তাই হোটেলটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। এখন হোটেল চালায় তার ছেলে। তবে মাঝে মাঝেই এক পাগল এসে ভাত খেয়ে যায়। ছেলেটির মা অসুস্থ তাই সে আর হোটেলে আসে না। সরকার জমি অধিগহন করবে তাই হোটেলটি ভেঙ্গে ফেলা হলো। তবে সেই পাগল এসে বাঁধা দেয়। কারণ সে প্রায়ই এখানে এসে ভাত খায়। বাচ্চাটি হোটেল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু সেই পাগল এসে বাঁধা দেয় এই জায়গায় নতুন রাস্তা করতে। বিষয়টা সে তার মায়ের কাছেও জানায়। কিন্তু হঠাত এদিকদিন ভুমি অফিস থেকে লোক এসে জানায় এই জমির মালিক এমুক। ফলে বাচ্চাটি সরকার থেকে অনেক টাকা পায়। টাকা পেলেও পাগলিটা নিয়মিত এসে সেখানে বসে থাকে।

অতপর একদিন ছেলেটির মা নতুন রাস্তা দেখতে আসে। রেল লাইন। এসে দেখে সেই পাগলটি মারা গেছে। কয়েক টুকরো লা”শ একসাথে করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাপড় দিয়ে নিচের অংশ ঢেকে রাখা হলেও উপরের অংশে কোনো কাপড় ছিল না। এ সময় মেয়েটি দেখতে পায় তার হাতে একটি দাগ। যেটি মূলত রান্না ঘরে রান্না দেখতে গিয়ে হাত পুড়ে হয়েছিল।

এসময় পুলিশ এসে লা*শ নিয়ে যেতে চায় কিন্তু মেয়েটি বাঁধ দেয় এবং বলে তার স্বামীর লা*শ। বুড়ির কথা শুনে তার ছেলে অবাক হয়। তবে এ যে তার বাপ সেটা সে বিশ্বাস করে। কারণ তার বাবাই তো তার নামে এই জমি কিনে রেখে গিয়েছিল। অতপর ছেলেটির অনেক ইচ্ছা হয় বাবার ডাক শুনতে ও তারও মন চায় বাবা ডাক দিতে। কিন্তু তা আর হয় না। বাবা ছেলে লাশের পাশে বসে কাঁদছে আর চোখের জ্বলে ভাসছে।

গাছ ও কুঠারের গল্প

একদিন গাছ কাটার সময় গাছ কুঠারকে বলল দেখ কুঠার এভাবে আমাকে কাটিস না, এর অপরাধে কিন্তু একদিন তোকেও পুড়তে হবে। কুঠার সেদিন হেসে হেসে বলল, তোকে পুড়িয়ে কয়লা বানানো হবে আর সেই কয়লা দিয়েই কিন্তু আবার তুই এই গাছকেই পোড়াবি।

গাছ লজ্জা পেয়ে আর কিছু বলল না। একদিন সেই কুঠারের মালিক কুঠারটি সান দেওয়ার জন্য এক কামারের কাছে নিয়ে যায়। কামার কুঠারটিকে কয়লায় পুড়িয়ে লাল করে ফেলে সান দেওয়ার জন্য।
এ সময় উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছ হাসতে হাসতে বলল, দেখ কুঠার আমাদের কেটেছিস এখন আমার পুড়িয়ে বানানো কয়লা দিয়েই তোকে পোড়া হচ্ছে। কঠারও তখন হাসতে হাসতে বলল, আমার সান দেওয়া শেষ হোক তখন বুঝবি কে কাকে পোড়ায় আর কে কে কাকে কাটে।

সান দেওয়া শেষে ওই কুঠারটি যখন আবার গাছ কাঠতে শুরু করল তখন গাছ আবার বলল, তোর কোনো লজ্জা নেই কুঠার। একটু আগে আমাদের কয়লা দিয়ে পোড়ালাম তাতে তোর বিচার হয় নি তাই না? কুঠার তখন হাসতে হাসতে বলল, আমাকে যত পোড়াবে আমি ততো ধার হবো আর তোদের কেটে সব বন ছাড়খার করে দিব। এভাবে কুঠার প্রতিদিন বনের সব গাছ কেটে ফেলতে লাগল।

বনের শেষ গাছে যখন কুঠারটি আঘাত করল তখন গাছটি বলল, আমাকে কাটিস না আর আমাকে কাটলে তোর আছাড়ি লাগানোর মতো আর গাছ থাকবে না। বনের সব গাছ শেষ হয়ে গেল। এরপর একদিন কুঠারের মালিক কুঠারটি নিয়ে কামারের কাছে যাবে সান দিতে। কিন্তু তখন দেখতে পেল কুঠারের আছাড়ি ভাঙা। ভাঙা আছাড়ি সহই কুঠারটি নিয়ে মালিক কামারের কাছে যায়। কামার সেই কুঠারটিকে কয়লার মধ্যে দেয় পোড়ানোর জন্য।

সাথে ভাঙা আছাড়িটিকেও কয়লার ময়লার মধ্যে ফেলে দেয়। তখন কুঠার, কয়লা ও আছাড়ি একসাথে পুড়তেছিল। এসময় কুঠারের মালিক কামারকে বলল, কুঠারের একটি আছাড়িও লাগিয়ে দেন। তখন কামার বলল, এই অঞ্চলে কোনো গাছ নেই তাই আমি আছাড়ি পাবো কই? এ সময় কয়লার মধ্যে পুড়তে থাকা ভাঙা আছাড়িটি কুঠারকে বলল, কাউকে ধংস করলে নিজেকেও ধংস হতে হয়। মনে রাখবি এ পৃথিবীতে কেউই স্বয়ংসমপূর্ণ নয়। সবাইই সবার উপর নির্ভরশীল। আমাদের ধংস করে দিয়েছোস এখন তুইও ধংস হয়ে যাবি।

লেখকঃ রেদোয়ান মাসুদ
কবি, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক

Exit mobile version