কাজী আরেফ আহমেদ

প্রাথমিক পরিচয়ঃ তখুড় আর নির্লোভ রাজনীতির এক বলিষ্ঠ উদাহরন মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলনের জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ। এই মহান ব্যক্তি ছিলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির অন্যতম রূপকার । বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রচনাও এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন । বাংলাদেশের প্রথম বিরোধীদল জাসদ গঠনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন এই জনদরদীনেতা। স্বাধীনতার সংগ্রামকালে এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির এক বিশুদ্ধ চরিত্রের নাম মেধা ও প্রঙ্গায় দীপ্যমান আপসহীন নেতা কাজী আরেফ আহমেদ। 

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত মহিয়ান নেতা কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৪৩সালে ৮ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার সদর থানার ঝউদিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবা ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার কচু ডারিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারের বাসিন্দা । কাজী আরেফ আহমেদের বাবার নাম কাজী আব্দুল কুদ্দুস ও মা খোদেজা খাতুন। 

শিক্ষা জীবনঃ মানব দরদী কাজী কাজী আরেফ আহমেদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে এবং সেখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । এরপর জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন । সেখান থেকেই ১৯৬৬ সালে বিএসসি পাশ করেন। এরপর মাস্টার ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে। কিন্তু আন্দোলন ,সংগ্রাম আর আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের ফলে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন না করেই শিক্ষা জীবনের সমাপ্ত করতে হয়। 

রাজনৈতিক জীবনঃ অনুকরনীয় রাজনীতিবিদ কাজী আরেফ আহমেদ রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ১৯৬০সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী আর সাহসী কাজী আরেফ আহমেদ অতিদ্রুত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন । এসময় তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করতে ছুটে বেরিয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে । দৃঢ়তা আর সাহসিকতার পুরষ্কার স্বরূপ তিনি পান ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতির পদক । ১৯৬৩ থেকে১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংসদের সদস্য । স্বাধীন জাতির রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তার নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে ছাত্র লীগের অভ্যন্তরে গঠিত হয় স্বাধীনতার “নিউক্লিয়াস” যা পরবর্তীতে “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ” নাম নেয়। ছাত্র আন্দোলনকে আরও বাগবান করার জন্য ১৯৬২ সালে তিনিই গঠন করেন “ইন্টার ডিগ্রি ছাত্র ফোরাম”। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্বাধীনতার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যান । ১৯৬৪ সালে শাসক গোষ্ঠীর চক্রান্তে সংঘটিত সাম্প্রতিক দাঙ্গা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ ।তার একক প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ১৪থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় বাংলা ভাষা প্রচলন সপ্তাহ । সেই দিন থেকে পূর্ব বাংলার অফিস-আদালত, দোকান পাট, গাড়ি সর্বত্র উর্দু ও ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়। ১৯৬৬সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষনা করলে অধিকাংশ নেতাসহ ডানপন্থী ও বামপন্থী নেতা মহল এর বিরোধিতা করে এই অবস্থায় কাজী আরেফ আহমেদ ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাংসদ ছয় দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এবং সম্পূর্ণ পরিস্থিতি পাল্টে দেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু আটক হলে ছয় দফা আন্দোলন ৮৬ এর গণ আন্দোলন ,৬৯এর গণ অভ্যন্থান সংগঠনে ঢাকা মহানগরীতে কাজী আরেফ আহমেদের ভূমিকা অতুলনীয়। ১৯৭০ সালের ৭জুন স্বাধীনতা দিবসের আগে ৬ জুন রাতে কাজী আরেফ আহমেদ ও আসম আব্দুর রফ সহ স্বাধীন বাংলা পরিষদের অন্যান্য নেতারা জাতীয় পতাকার রূপদান করেন। পরদিন জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে এই পতাকা বহন করা হয়। ১৯৭১সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় আসম আব্দুর রফ প্রথম ঐ পতাকা উত্তোলন করেন। সেই দিন থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন “বেঙ্গল লিবারেশন ফন্ট”(বিএফ আই)বা মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠন ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। পশ্চিম রণাঙ্গনে পাবনা,কুষ্টিয়া,চুয়াডাঙ্গা,যশোর,মেহেরপুর,ঝিনাইদাহ , মাগুরা, নড়াইল, খুলনা,বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর , গোপালগঞ্জ , রাজবাড়ি, ও ফরিদপুর নিয়ে গঠিত অঞ্চলের রিক্রটমেন্ট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধফেরত এক ঝাঁক উদীয়মান তরুণদের নিয়ে ১৯৭১সালে কাজী আরেফ গঠন করেন জাসদ ।১৯৭৫সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধ ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আট বছরের লড়াইয়ে রাজপথে যে জোটটি পরিণত হয়ে উঠেছিল আন্দোলন সংগ্রামের চালিকা শক্তি , সেই “পাঁচ দল” এর শীর্ষ নেতৃত্ব ছিলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে তাকে দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। ১৯৯০ এর ঐতিহাসিক গণভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান সাহসী রূপকার ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধাপরধীদের বিচারের দাবিতে জননী জাহানারা ইমামকে সাথে নিয়ে গঠন করেন ১৯৭১এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ।তিনি এর কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য । ষাটের দশকের শুরু থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতির গতি প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে কাজী আরেফ আহমেদ এক বিচক্ষন রাজনীতির ভূমিকা পালন করেন।

পারিবারিক জীবনঃ বিপ্লবী বীর কাজী আরেফ আহমেদের স্ত্রীর নাম সংসদ সদস্য রওশন জাহান সাথী। তিনিও একজন বীর মুক্তিযুদ্ধা।  ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে কাজী আরেফের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধথেকে শুরু করে জাসদ প্রতিষ্ঠা , স্বৈরচার সরকার বিরুধী আন্দোলন সকল ক্ষেত্রেই কাজী আরেফের একজন সক্রিয় কর্মীর নাম স্ত্রী রওশন জাহান সাথী। রাজনৈতিক জীবনের বাইরে তারা গড়ে তুলেছিল এক শান্তিময় নীড়।নির্লোপ এই দুজন রাজনীতিবিদদের অর্থের প্রতি কোন লোভ ছিলনা। তাই তাদের বাড়িতে স্থান পায়নি দামী দামী আসবাবপত্র। স্বামী স্ত্রী এক হয়ে কাজ করেছেন মেহনতি এবং শ্রমজীবি মানুষের পক্ষে গড়েছেন এক অনুকরনীয় পারিবারিক জীবন। 

মৃত্যুঃ শোষন মুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নেতা জীবনের শেষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রমজীবি ,কর্মজীবী , পেশাজীবি জনগনের অধিকার ,ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রমকর্ম পেশার প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হয়ে সমগ্র দলকে একাত্নতার জন্য কাজ করেছেন । স’ন্ত্রা’স আর জ;ঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তিব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় সভা সমাবেশ করেন । তারই অংশ হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যান কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার কালিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের জাসদের মঞ্চে। এটিই তার জীবনের শেষ সভা । সেই দিন জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ সহ আরো কয়েকজন জাসদনেতাকে নির্ম’ম ভাবে গু’লি চালিয়ে হ”ত্যা করে একদল অস্রধারী স’ন্ত্রা’সী। প্রত্যক্ষ দর্শীদের মতে ঐ দিন বৃষ্টির মতো গু’লি ছো;ড়া হয়েছিল।

ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া

প্রাথমিক পরিচয়ঃ

ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার আসল পরিচয় হল তিনি ছিলেন অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ের কথা। তিনি ছিলেন একজন রাজনিতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সমাজসেবক। তাকে একজন ধর্ম প্রচারক বলা হয়। ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন বি প্রকাশ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্টার মাধ্যমে তিনি সমাজে একজন ইসালামি চিন্তাবিদ হিসেবে ও পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ছিলেন ত্যকালিন প্রাদেশিক পরিষদের প্রধান মন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হকের রাজনিতিক উপদেষ্টা ছিলেন।

জন্ম ও পরিচয়ঃ
বিখ্যাত রাজনিতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সমাজসেবক ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া ১৮৯৪ সালে ২৮ ফেব্রু ত্যকালিন রাজশাহী বর্তমান চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার দাদন চক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম লাহার উদ্দিন হাজী ও মাতার নাম তুলন বিবি। বাবা ছিলেন ধর্ম গুরু মা ছিলেন গৃহিণী। ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার ডাক নাম ছিল ‘’ ভাদু’’। ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেনির। তবে পরিবারের সবাই ছিল অত্যন্ত ধর্ম পরায়ণ। পরিবারের সবায় ছিল মোটামোটি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী ছিল।

পরিবার পরিচিতিঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার ছিল তিন ভাই তবে তার বোনের সংখ্যা জানা যায় নি। ভাইদের নাম মুন্সী সুলতান হোসেন, মুহাম্মদ শাহ-জামান, ও মুহাম্মদ ইরফান আলী। ভড় ভাই মুন্সী সুলতান হোসেন ছিল আরবি ও ফার্সি ভাষায় পারদর্শী তাই তাকে মুন্সী বলে ডাকত। এছাড়া তার অন্য দুই ভাই ছিল শিক্ষিত। তার বোনদের নাম না জানা গেলেও তার শিক্ষা জিবনে তাদের বোনের সম্পর্কে জানা যায়। শিশু ‘ ভাদু’’ (ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া )পড়ালেখা হাতেখড়ি ছিল তার ভাই বোনদের হাতে।

শিক্ষা জীবনঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেনির। তবে পরিবারের সবাই ছিল অত্যন্ত ধর্ম পরায়ণ। পরিবারের সবায় ছিল মোটামোটি ফার্সি ভাষায় পারদর্শী ছিল। তার পড়ালেখা হাতেখড়ি ছিল তার পরিবারের ভাই বোনদের হাতে। তার ভাই বোনদের হাতে আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখেন। ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার বাড়ির কাছে কোন স্কুল প্রতিষ্টান ছিলনা। তায় তাকে ভর্তি করা হয় ১৯০৩ সালে প্রায় তিন মাইল দূরে দুর্লভপুর এম,ই স্কুলে। এখানে তিনি ৬ষ্ট শ্রেনি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ১৯০৯ সালে তিনি ভর্তি হন মুর্শিদাবাদ জেলার নবাব বাহাদুর স্কুলে। ১৯১২ সালে ভর্তি হন মুর্শিদাবাদ সূতি থানার কাঞ্চনতলা স্কুলে। কাঞ্চনতলা স্কুলে ছেড়ে ভর্তি হন নিমতিতা হাই স্কুলে এখান থেকে তিনি ১৯১৩ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। এখান থেকে তিনি ১৯১৫ সালে আই, এ পাশ করে বি,এ ভর্তি হন ১৯১৮ সালে ও তিনি কৃতিতের সাথে পাশ করেন। এছাড়া তিনি দিল্লীর জামিয়া মিলিয়াতে কিছুকাল পড়ালেখা করেন। তবে তিনি পড়ালেখা শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরেন।

বিবাহ বন্ধন ও পারিবারিক জীবনঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া মাত্র ১৯ বছর বয়সে চককীতি গ্রামের( শিশু) কন্যা দেল আফরোজ বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় তিনি ছিলেন নিমতিতা হাই স্কুলে এর বিদায়ী ছাত্র। ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া ও দেল আফরোজ বেগম এর ছিল ৭ টি সন্তান। এরমধ্য ৩ জন পুত্র ও ৪ জন কন্যা। এদের নাম ইকবাল, তাসাদ্দক, রাবেয়া, জিন্নাতুল, তাহেরা, সুদিজান, ও রশিদা, তাদের প্রথম পুত্র ইকবাল, তাসাদ্দক ছিল জমজ । ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার বিয়ের মাত্র ১৬ বছর পর তার বাবা মৃতু বরন করেন। মৃতুর পর ভাইদের মধ্য দন্দ হলে সকলে পৃতক হয়ে যায়।

রাজনৈতিক জীবনঃ
রাজনৈতিক জীবনের অনুপ্রেরনা পান রাজশাহী কলেজে থেকে। এ কলেজে তার সহ পাঠি হিসেবে পান পূর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্রী আবু হোসেন সরকারকে। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় তার সাথে দেখা হয় শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হকের সাথে। ১৯১৮ সালে দিল্লীর জামিয়া মিলিয়াতে কিছুকাল পড়ালেখা করার সময় বন্ধুত্ব হয় ঢাকার নবাবা খাজা নাজিম উদ্দিনের সাথে। এতে তিনি রাজনৈতিক জিবনে জড়িয়ে পড়েন। এরপর আস্তে আস্তে তিনি রাজনৈতিক, সমাজ সেবক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশেষ করে কৃষকদের ন্যায্য অধিকার আদায় জমিদারদের বিরুব্দে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৬ সালে ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া দুর্লভপুরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি হলেন প্রথম ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ১৯২৯ সালে তিনি মালদহ জেলা প্রজা সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে দক্ষিণ মলদহ কৃষক প্রজা পার্টির থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় সভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪২ সালে মলদহ জেলার বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে পূর্ব বাংলার আইন সভার নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপরীতে স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচন করে পরাজয় বরন করেন। ১৯৪৬ সালে ভাষা আন্দোলনে পক্ষে বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য প্রদান করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি বাংলা ভাষাকে সমর্থন করেন। ১৯৫৪ সালে প্রদেশিক নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে শিবগঞ্জ থেকে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে শামরিক শাসন জারি হলে প্রাদেশিক পরিষদে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে তিনি শিবগঞ্জ………………………।

কৃষক আন্দোলনে ইদ্রিস আহম্মদঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া এর রাজনীতির সূচনা হয় কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমেই। তার রাজনীতির মূল শক্তি ছিল সাধারণ কৃষক, দিনমুজুর, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত জনগণ। এদের ভোটের মাধ্যমে তিনি বার বার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সাধারণ কৃষকদের একত্রে নিয়ে তিনি জমিদার মহাজন শোষকদের বিরুধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ময়মনসিংহের কৃষি সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকার কৃষক সম্মেলনে যোগদেন। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে তিনি তার এলাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্টাণ করেন। কৃষকদের প্রতি তার অবস্তান নেয়াতে জমিদার, মহাজন শ্রেনির লোকেরা তার প্রতিষ্টীত মাদ্রাসায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। যেখানে কৃষকদের প্রতি জমিদার, মহাজন শ্রেনির লোকেরা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত করতেন সেখানেই তিনি ছুটে যেতেন। তিনি জমিদার, মহাজন শ্রেনির লোকেরা কাছে কাটা হয়ে যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কৃষকদের সেবা করে গেছেন। এর কারনে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে অসাধারন মানুষ হিসেবে আজীবন বেচে থাকবেন। ১৯৩৭ সালে তিনি আইন সভায় কৃষকদের অত্যাচারিত ও নির্যাতিত এর বিরুধে আইন পাশ করেন।

আত্নমানবতার সেবায় ইদ্রিস আহম্মদ মিয়াঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া তার পুরু জীবনটায় আত্নমানবতায় সেবা করে গেছেন। ১৯০৯ সালে ৭ম শ্রেনিতে পড়ার সময় গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়া লেখা করার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে একজন বালক দ্বারা স্কুল স্থাপন করা বিরল দৃষ্টান্ত। স্থানীয় লোকের শিক্ষার জন্য ১৯১৯ সালে দাদন চকে একটি আধুনিক মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ১৯২০ সালে কৃষকদের প্রতি তার অবস্তান নেয়াতে জমিদার, মহাজন শ্রেনির লোকেরা তার প্রতিষ্টীত মাদ্রাসায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। পরে তিনি সরকার ও জনগণের সাহায্য পাকা করে মাদ্রাসাটির পূর্ণ নির্মাণ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি নির্মাণ করেন আদিনা ফজলুল হক কলেজ। ঐ সময় থানা পর্যায়ে কোন কলেজ ছিলনা। কিন্তু তিনি একটি কলেজ নির্মাণ করেন। ১৯৮৬ সালে এটিকে সরকারি করা হয়। এছাড়াও তিনি ফজলুল হক মোয়াল্লেম ট্রেনিং , ফজলুল হক গুরু ট্রেনিং এবং দাদনচক হাই স্কুল নির্মাণ করেন। ১৯৩৮ সালে বন্যায় দুর্গতদের মধ্য সাহায্য ও পূর্ণ বাস্থান নির্মাণে জন্য তিনি সাহায্য করেন। তার নেতৃতে বন্যা রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। বন্যায় দুর্গতদের মধ্য সাহায্য ও পূর্ণ বাস্থান নির্মাণে জন্য তিনি ঐ সময়ের খাদ্য মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর সাথে দেখা করেন। দুই দিক থেকে সাহায্য নিয়ে এলাকার মানুষের জন্য সাহায্য করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল স্থাপন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনেও তার অবদান রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তিনি মাদার বখশের সাথে একত্ব প্রকাশ করে ভিবিন্ন মিটিং সমাভেশ করেন। এছাড়াও তিনি গরিব ছাত্রদের সাহায্য করেন।
সাহিত্যিক জীবনঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া রাজনীতি, সমাজ সেবার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। সাহিত্যিক ক্ষেত্রে ও তার অবদান কম নয়। ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার সাহিত্যিক ঘটনা শুরু হয় স্কুল থেকে। তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষা জানত বলে ইসলামি গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও তার অবদান কম নয়। ১৯০৫ সালে তিনি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ( ১ম প্রকাশিত গ্রন্থ ) ‘’ ইসলাম সঙ্গীত’’’ ১৯০৯ সালে রচনা করে গেছেন ‘’পতিতইসলাম’’ একটি কাব্য গ্রন্থ। ১৯২৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘’কোরআনের মহাশিক্ষ’’ গ্রন্থতির ১ম খণ্ড। ১৯২৭ সালে প্রকাশ করেন ২য় খণ্ড, ১৯৩৪ সালে প্রকাশ করেন ৩য় খণ্ড। এর ফলে তিনি মুসলিম সমাজে অনেক পরিচিতি লাভ করেন। এই গ্রন্থ পরে মানুষ সহজেই কোরআন ও হজরত মহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে ধারনা লাভ করতে পারেন। কারন বইটি ছিল বাংলা ভাষায় রচিত। এরপর রচনা করেন ‘’হাদিসের প্রকৃত শিক্ষা’’ ১৯২৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন অর্থ উপার্জনের সহজ পথ। ১৯২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘’কৃষকের মর্মবাণী’’’। এরপর প্রকাশ করেন ‘’ বাংলাদেশের ইতিহাস’’ । তার সকল বই ঐ সময় ব্যপক পরিচিতি লাভ করেন। ভিবিন্ন পত্রিকায় তার লেখা বের হত। তার সব লেখা ছিল ইসলাম ও কৃষকদের অধিকার নিয়ে। পত্রিকায় প্রকাশিত গুলোর মধ্য ‘’ দুনিয়ার বোঝা চাষার ঘাড়ে’’ উপায় কি আর উপোষ ছাড়া, অতি আপন চাষী ভাই, ইত্যাদি।

ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া রচিত গ্রন্থ গুলো হলঃ
ইসলাম সংগীত ১৯০৫, ‘’ বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’’, ‘’কৃষকের মর্মবাণী ১৯২১, পতিত ইসলাম ১৯২৩, ‘’কোরআনের মহাশিক্ষ’’ গ্রন্থতির ১ম খণ্ড ১৯২৩, লাক্ষা আবাদ, আর্থ উপার্জনে স্বাধীন সহজ পথ, ১৯২৭, প্রজার দুঃখ কাহিনী ১৯৩৬, হাদিসের প্রকৃত শিক্ষা ১৯৩৬, ‘’কোরআনের মহাশিক্ষ’’ গ্রন্থতির ২য় খণ্ড, ১৯২৭, ‘’কোরআনের মহাশিক্ষ’’ গ্রন্থতির ৩য় খণ্ড ১৯৩৪,
অপ্রকাশিত গ্রন্থঃ
জবা, গোলাপ, গোল আন্দাম, ছোট গল্প, প্রলাপ বন্যা, তিন তালাকে বিপত্তি , মানুষ না মেথর, সাত জাতির দুর্দর্শা, সমাজ তরী , সুদের আইন।

সাংবাদিক জীবনঃ
রাজনীতি, সাহিত্য চর্চা, সমাজ সেবা, সাংবাদিক সব কিছুতেই ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার ছিল অবদান ও সাফ্ল্যতা। তিনি প্রথম দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সংবাদ পাঠাতেন। পরে তিনি এই পত্রিকার সাথে বালভাবে জড়িয়ে যান। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘’ ইসলাম প্রভা’’ নামে একটি পত্রিকায় সম্পাদনা করেন। তিনি দৈনিক নবযুগ, মাসিক মোহাম্মদ ও দৈনিক আজাদ পত্রিকায় নিয়মিত লিখেন। তিনি কাজী নজরুলের ‘ নবযুগ’ পত্রিকার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এতে তিনি কৃষকের সমাজ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার ছাপাকল Board of Director ছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি দাদন চকে একটি ছাপাকল মেশিন স্থাপন করেন। তিনি সাংবাদিক জিবনে বেশী সময় না পেলেও সংবাদ পত্রে লেখার মাধ্যমে তিনি কৃষকের জীবন চিত্র তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি কৃষকদের অত্যাচারের খবর ও তাদের প্রকৃত জীবন চিত্র গণ মানুষের কাছে প্রকাশ করেন।

সন্মাননাও স্বীকৃতিঃ
ইদ্রিস আহম্মদ মিয়ার জীবনে সবচেয়ে বেশী সন্মাননাও স্বীকৃতি পেয়েছেন তার সবচেয়ে প্রিয় কৃষকদের কাছ থেকে। এজন্য তিনি গরিবদের পাশে থাকের জন্য এবং সাহায্য করার জন্য সে সময় তাকে ‘’ গরিবের বন্দু’’ বলে ডাকা হত। তার মৃত্যুর ২৫ বছর পর বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর পদক প্রদান করে তার কর্মের সন্মাননাও স্বীকৃতি প্রদান করেন।

মৃত্যুঃ
অবশেষে ১৯৬৬ সালে ৯ অক্টোবর ইদ্রিস আহম্মদ মিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন। তখন তার বয়স ছিল ৬৭ বছর। মৃত্যুর পর আদিনা ফজলুল হক কলেজ পাজ্ঞনে দাফন করে

উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী

প্রাথমিক পরিচয়ঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে এক নক্ষত্রের নাম। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক সাংবাদিক ও চিত্রকর। তাকে সঙ্গীতও বলা হয়। এর জন্য কিশোরগঞ্জে রায় পরিবারের সুনাম পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে যান। তার ছেলে সুকমার রায় ও তাকে ছাড়িয়ে যান। পরে তার নাতি ( সুকমার রায়ের ছেলে) সত্যাজিৎ রায় অস্কার বিজয়ের মাধ্যমে রায় পরিবারের সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। রায় পরিবারের তিনি প্রজন্মের তিন পুরুষই শিশু সাহিত্যর এক অনন্য নাম। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী এর সূত্রপাত করেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ-১
বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১৯৬৩ সালে ১০ মে ( তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ) বর্তমান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার মসুয়া গ্রামে এক ধনী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শ্যামসুন্দর মুন্সী। ও মায়ের নাম জয়তারা। শ্যামসুন্দর মুন্সীর অপর নাম কালীনাথ চৌধরী। শ্যামসুন্দর মুন্সী ও জয়তারার ঘরে আসে ৮টি সন্তান। সরাদারঞ্জ, গিরিবালা, কামদারঞ্জন,( ? ) কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন, ও মৃনালিনি। কাদারঞ্জন পরবর্তীতে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। তার বড় ভাই সরাদারঞ্জন ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ।

জন্ম ও বংশ পরিচয় ২ –ঃ
কালীনাথ রায় ( শ্যামসুন্দর মুন্সী ) এক নিকট আত্নীয় হরি কিশোর চৌধরী বাস করতেন একই গ্রামে। তিনি ছিলেন এই গ্রামের এক প্রভাবশালী লোক। সম্পদের দিক দেয়েও শ্যামসুন্দর মুন্সীর চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে দুঃখের বিষয় এক দিক দিয়ে তিনি পিছিয়ে। শ্যামসুন্দর মুন্সীর ৮ সন্তান কিন্তু হরি কিশোর চৌধরীর কোন সন্তান ছিলনা। তাই হরি কিশোর চৌধরী শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছে একটি সন্তান দত্তক হিসেবে চান। আত্নীয় সম্পর্কর জন্য তিনি রাজি হয়। এবং তার ৫ বছরের ছেলে কামদারঞ্জনকে ( উপেন্দ্র কিশোর) নির্দাবী করে দিয়ে দেন। হরি কিশোর চৌধরী খুশি হয়ে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর নামে তার সকল জমি লিখে দেন। এবং কামদারঞ্জন নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। তবে পরবর্তীতে হরি কিশোর চৌধরীর ঘরে একটি ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। তার নাম নরেন্দ্র কিশোর। পরে হরি কিশোর চৌধরী মারা যায়। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন এবং নরেন্দ্র কিশোর তার বাবার জমিদারির ভার গ্রহণ করেন। তবে উল্লেখ্য যে এই জমিদারিতে নরেন্দ্রর কোন অংশীদারী ছিল না। কারন হরি কিশোর চৌধরী উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর নামে তার সকল জমি লিখে দেন। কিন্তু পরে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার সম্পতির অর্ধেক তার ছোট ভাই নরেন্দ্র কিশোর এর নামে লিখে দেন। এবং বাকি অর্ধেক সম্পতি তিনি তাকেই দেখার দায়িত্ব দেন।

শৈশবঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর শৈশব কাটে প্রথম ৫ বছর নিজ পরিবারে। পরের সময়টা কাটে হরি কিশোর চৌধরীর বাড়িতে। পরবর্তীতে তার উইলকৃত নিজ বাড়িতে। তৎকালীন ময়মনসিংহে মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদীতে। এই নদীর কূলেই ছিল মসূয়া গ্রাম। তিনি বড় হন এই নদী দেখে। তা ছাড়া তাদের মসূয়া গ্রামটি ছিল গাছ-পালা নদী-নালায় এক সুন্দর্যর অপরূপ নিলা ভূমি।। ব্রহ্মপুত্র নদীর কল কল দেউয়ের শব্দ ও রূপ নিয়ে তিনি বড় হন। চারদিকে ফসলের মাঠ তাকে করে প্রানবন্দ। এই ব্রহ্মপুত্র নদী ও গ্রাম তাকে সাহিত্যর প্রতি মন গড়তে সাহায্য করেন। বাবা হরি কিশোর চৌধরীর কাছে তিনি ছিলেন একটি হিরের টুকরা। তাই আদরে যত্নে তার কোন অভাব হয়নি। যখন যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। তার পড়ালেখার প্রতি তারা বাবা হরি কিশোর চৌধরী ছিলেন অনেক আগ্রহী। তাকে ভর্তি করেন স্কুলে। তিনি গান বাজনার প্রতি ছিল আগ্রহী। যেখানে গান বাজনা ও সাংস্কৃতি অনুষ্টান হত সেখানেই তিনি অংশ গ্রহণ করতেন। তাই বলা যায় একজন সাহিত্যমনা মানুষের যে ধরনের পরিবেশের ধরকার উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার পুরুটায় পেয়েছেন।

শিক্ষা জীবনঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পড়ালেখার শুরু করেন তার নিজ বাড়িতে (হরি কিশোর চৌধরীর বাড়িতে ) । তার বাল্য শিক্ষার জন্য এক পণ্ডিত রাখা হয় তার নিজ বাড়িতে। এরপর তাকে ভর্তি করেন ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে। ময়মনসিংহে এসে তিনি গগনচন্দ্র নামে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সংস্পর্শে আসেন। তিনি ব্রাহ্মণ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮৮০ সালে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ময়মনসিংহের জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। এরপর তাকে ভর্তি করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে। এ কলেজ থেকে তিনি ১৮৮২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হয় কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজে বি,এ ক্লাসে। ১৮৮৪ সালে তিনি বি,এ পাশ করেন। এরপর তিনি পড়ালেখার ইতি টানেন।

বিবাহ বন্ধন ও পারিবারিক জীবনঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী কলকাতায় থাকার সময় শরীয়তপুরের লনসিং স্কুলের পণ্ডিত ( পরে কলকাতায় স্থানান্তরিত ) দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যয়ের বাসায় আসা যাওয়া করতেন। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যয় ছিলেন একজন নারী শিক্ষার অগ্রপথিক। তার স্ত্রী বরিশালের মেয়ে কদম্বিনী দেবী ছিল ১ম ভারতীয় গ্রাজুয়েট মহিলা ডাক্তার। তাদের বাসায় যাওয়া আসা সুবাদে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যয়ের বড় কন্যা বিধুমুখীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৮৮৬ সালে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী পারিবারিক মত উপেক্ষা করে বিধুমুখীকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসেন। প্রথম দিকে তাদের বিয়ে মেনে না নিলেও পরে ছেলের কথা চিন্তা করে এই বিয়ে মেনে নেন। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও বিধুমুখীর ঘরে আসে ৬টি সন্তান। ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। ছেলেরা হল সুকুমার রায়, সুবিনয় রায়, ও সুবিমল রায় ( মেয়ে ) সুখলতা রায়, পুন্যলতা চক্রবর্তী, ও শান্তিলতা রায়। তার বড় ছেলে সুকুমার রায় ছিল একজন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক। তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে F. R. P. S উপাধি পান। সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায়ও ছিল একজন শিশু সাহিত্যিক এবং ১ম বাঙ্গালী অস্কার বিজয়ী। তার ২য় ছেলে পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। ছোট ছেলে সুবিনয় গল্প ও কবিতা লিখতেন। বড় মেয়ে ছিল গল্পকার, চিত্রকার ও বহু গানের রচয়িতা। ২য় কন্যা একজন শিশু সাহিত্যিক ও ছোট কন্যা অকালে মারা যান।

কর্ম জীবনঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করেছিলেন। এই জন্য চাকরির জন্য কারো কাছে যেতে হয়নি। প্রেস ব্যবসা, ছবি আঁকা, সংবাদপত্র প্রকাশ, বই লেখা এই গুলোকে তিনি কর্ম হিসেবে বেঁচে নেন। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ময়মনসিংহের জেলা স্কুলে পড়ার সময় তিনি ছবি আঁকা শিখেন। কলকাতায় মেট্রোপলিটন কলেজে বি,এ পাশ কারার পর তিনি ভিবিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখতেন এবং ছবি আঁকতেন। ১৮৮৫ সালে তিনি নিজেই একটি প্রেস প্রতিষ্টা করেন। প্রেসের নাম দেয় ইউ রায় এ্যান্ড সন্স। প্রেসটির জন্য তিনি যন্ত্রপাতি আনেন ইংল্যান্ড থেকে। এ প্রেসে তিনি নিজের বই ও পত্রিকা ছাপাতেন। পাশাপাশি তিনি অন্যদের কাছথেকে ও অর্ডার নিতেন। তিনি নিজের বইয়ের ছবি নিজেই আঁকতেন। এবং তিনি অন্যদের বই, পত্রিকার ও পোস্টারের ছবি আঁকতেন। এতে তার ভালই আয় হত। তার প্রেসের মান ভাল তাই চারদিকে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। একসময় তার কাজের প্রেসার আরও বেড়ে যায়। এছাড়াও বই লেখা, পত্রিকার জন্য অনেক সময় দিতে হত। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে সুকুমার রায় ইংল্যান্ড থেকে ছবি আঁকা মুদ্রণ ও স্টুডিও পরিচালনার উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে বাবার প্রেসে কাজ শুরু করে দেন। এরপর তাদের প্রেসের উন্নতি আরও বেড়ে যায়। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর সুকুমার রায় প্রেসের ভার নেন।

সাংবাদিক জীবনঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। মেট্রোপলিটন কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘ সখা” ও মুকুল পত্রিকায় লিখতেন। ১৯১৩ সালে তিনি নিজেই একটি পত্রিকা খুলেন। এর নাম দেন সন্দেশ। পত্রিকার সম্পাদনার ভারও নিলেন তিনি নিজেই। এ পত্রিকায় তার নিজের লেখার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য লেখকদের লেখাও ছাপা হত। এ পত্রিকায় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজয় চন্দ্র, শিব নাথ শাস্রী, যোগেশ্চন্দ্র সহ বিখ্যাত লেখকেরা লেখা পাঠাতেন। এ ছাড়া তার পরিবারের সকলেই ছিল লেখক। তার পরিবারের সকলেই সাহিত্যর প্রতি এমনই আগ্রহ ছিল যে অন্য কেউ লেখা না পাঠালেও উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পত্রিকা ছাপাতে কোন ধরনের সমস্যা হত না। কারন তার পরিবারের সকলে ছিল সাহিত্যমনা। তার নিজের প্রেসে তিনি সন্দেশ পত্রিকা ছাপাতেন। তিনি পত্রিকার ছবি নিজেই আঁকতেন। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী সাহিত্য , সাংবাদিকতা, চিত্র আঁকার পাশাপাশি তিনি সংগীত চর্চাও করতেন। তিনি বেহালা, ঢোল, সেতার, ও হারমনিয়াম বাজাতে পড়তেন। এক সময় তিনি বাদ্যযন্ত্র প্রস্তুতকারক ‘ ডোয়াকিন কোম্পানি’ একটি সঙ্গীত পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির নাম দেন ‘ সঙ্গীত শিক্ষা” এর সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করেন।

সাহিত্যিক জীবনঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী শুধু একজন সুসাহিত্যিকই নয় তিনি সাহিত্য তৈরির কারিগর বটে। তিনি নিজে সাহিত্য চর্চা করতেন এবং পাশাপাশি তার পরিবারের সকলকে সাহিত্যমনা করে তুলেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন। ছাত্র অবস্তায় তিনি প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক প্রমদাচরন সেন প্রতিষ্টিত ‘ সখ’ পত্রিকায় লেখা পাটাতেন। ১৮৮৩ সালে তার প্রথম লেখা ‘ মাছি’ শিশুতোষ নিবন্দ সখ পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর তিনি নিয়মিত এই পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। পর মাকড়সা, ধূমপান, নিয়ম এবং অনিয়ম, গিলফর সাহেবের অদ্ভুত সমুদ্র যাত্রা ইত্যাদি অনেক গুলো লেখা প্রকাশ হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশ করলে তার লেখা বেশিরভাগ এই পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ছেলেদের রামায়ন। এটি তার প্রথম প্রকাশিত বই। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় সেকালের কথা বইটি। এটি ছিল জীববিদ্যার উপর লেখা। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘ ছেলেদের মহাভারত’। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘মহাভারতের গল্প” গ্রন্থটি। এই দুটি পুরানিক কাহিনী। এই তিনটি গ্রন্থ তৎকালীন কিশোরদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগান। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘ টুটুনির বই’ গল্পটি। এই বইটি শিশু কিশোরদের নিয়ে লেখা। এটি শিশু সাহিত্যর ক্ষেত্রে তার এক অবদান। উনিশ শতক থেকে শুরু করে এখনও বইটি এটি একটি জনপ্রিয় বই। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ ছোটদের রামায়ন’ বইটি প্রকাশের ৬ বছর পর প্রকাশিত হয় ‘ আরও গল্প’’ নামে আরেকটি গল্প বই। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘ পুরানের গল্প’’ নামক বইটি। এই দুটি পুরান কাহিনী সম্বলিত। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী রচিত প্রায় সকল বই ছোটদের জন্য রচিত। সে সময় এই সকল বই শিশুদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

মৃত্যুঃ
উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী জীবনের শেষ সময়ে এসে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন। সে সময় এ রোগের তেমন চিকিৎসা ছিলনা। তাই তিনি এই রোগে অনেক ভেঙ্গে পড়েন। পড়ে ১৯১৫ সালে ২০ই ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কেদারনাথ মজুমদার

প্রাথমিক পরিচয়ঃ
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ,সাংবাদিক ও সাহিত্যিক কেদারনাথ মজুমদার বাংলা ১২৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি ১৮৭০) বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার নিজ বাড়ি গচিহাটা গ্রামে। তার বাবার নাম লোকনাথ মজুমদার ও মায়ের নাম জয়দুর্গা দেবী। মাতৃভূমির প্রতি তার ছিল গভির ভালবাসা। আর সেই ভালবাসার কারনেই তিনি আমৃত্যু পর্যন্ত গবেষণা করে গেছেন তার নিজ জেলা ময়মনসিংহের(তৎকালীন) ইতিহাস নিয়ে। তবে ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা শুধু ময়মনসিংহ জেলাকে নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর বাইরেও তিনি ‘ঢাকার বিবরণ’ ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামের গ্রন্থটির কোন হদিস এখনও পাওয়া যায় নাই।
শিক্ষা জীবনঃ
কেদারনাথ মজুমদার পড়ালেখা শুরু হয় তার নিজ গ্রামের স্কুলে। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি চলে আছেন ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে তিনি ভর্তি হন নাসিরাবাদ এন্ট্রাস স্কুলে। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ সিটি স্কুলে। ময়মনসিংহ সিটি স্কুল ছেড়ে ১৮৮৪ সালে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে তিনি ১৮৮৯ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। এখানেই তিনি তার পড়ালেখা জীবনের ইতি টানেন।

সাহিত্যের সূচনাঃ
কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় তার নিজ বাড়ি থেকেই। তার বাবা-মা লোকনাথ মজুমদার ও জয়দুর্গা দেবী উভয়ই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। আর তাদের অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন। নাসিরাবাদ স্কুলের হেড পণ্ডিত বেদজ্ঞ উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে শাস্ত্র ও পুরাণনুশীলনে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের শিক্ষক শ্রীনাথ চন্দ্র তাকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জোগান। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’ এ সাহিত্য চর্চা করতেন।

চাকরি জীবনঃ
কেদারনাথয় মজুমদারের বাবা-মার সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল। যা তিনি পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। তাই সংসার চালানোর জন্য তিনি সামান্য বেতনে ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের ফৌজদারি নকল থানায় নকলনবীশের চাকরি নেন। তবে তিন যে পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা দিয়ে চাকরি পাওয়া খুব সহজ ছিল না। তাই তার মামা কৃষ্ণকুমার রায় তাকে এ চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। চাকরিতে যে বেতন পেতেন তা দিয়ে সংসার চালানোই ছিল দায়। আর এ চাকরির উপর নির্ভর করেই তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন। তবে তিনি সাহিত্য চর্চার খরচ যোগানের জন্য চাকরির পাশাপাশি পাঠ্য বই প্রণয়ন, ছাপখানা পরিচালনা ও মানচিত্র প্রকাশ ইত্যাদি কাজ করতেন। চাকরি জীবনে তিনি একসময় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ অসুস্থ তিনি ১৯০১ সালে চাকরি ছেড়ে দেন।

সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জীবনঃ
কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই। স্কুলে পড়ার সময় তিনি রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস ‘স্রোতের ফুল’। তিনি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রচনা করেন ‘ঢাকা সহচর(১৯০৮-২য় সংস্করণ)’, ময়মনসিংহ সহচর(১৯০৮), বাংলা সহচর, আদর্শ গণিত ও সচিত্রা ভুগল। চাকরি করলেও কেদারনাথ মজুমদারের সাহিত্যকর্ম ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন নামকরা পত্র-পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হত অহরহ। চাকরি অবস্থাতেই তিনি সম্পাদনা করেন ‘সাময়িকপত্র’। এক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্য কলকাতা যান। কিন্তু সেখানে গিয়েও তার সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি। সংগ্রহ করতেন বিভিন্ন রকমের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ পাঠ যা তিনি অসুস্থতার মধ্যেও তিনি হাতে লিখে নিতেন।

বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ মাস থেকে তিনি ‘কুমার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেটি প্রকাশ হয়েছিলো বাংলা ১২৯৫ সালের বৈশাখ সংখ্যা থেকে শ্রাবন সংখ্যা পর্যন্ত। কুমার পত্রিকা বন্ধ হলে তিনি চালু করেন ‘বাসনা’ নামে আরেকটি পত্রিকা। এরপর তিনি ‘আরতি’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলা ১৩১৯ সালের কার্তিক মাসে তিনি ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি ‘সম্মিলন’ নামে একটি পত্রিকার পরিচালক নিযুক্ত হন। যার জন্য তিনি কিছুদিন ঢাকায় বসবাস করেন।

‘সৌরোভ’ পত্রিকাটি প্রথমে পুস্তাকারে প্রকাশ হত, পরবর্তীতে তিনি এটাকে ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশ করেন। ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি ময়মনসিংহে নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রিসার্চ হাউস’ এবং পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ প্রেস’। তার প্রতিষ্ঠিত সৌরভ পত্রিকাটি ছিল সাহিত্যের প্রাণ স্বরূপ। সেখানে লিখতেন পবিত্র কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, সবভাব কবি গোবিন্দ দাস, চন্দ্রকুমার দে ও সৌরভ কুমার রায়সহ নামকরা কবি-সাহিত্যিকগণ। তবে ‘সৌরভ’ পত্রিকাটি ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের পর বন্ধ হয়ে যায়।

কেদারনাথ মজুমদার এক সময় সাহিত্যের মধ্যমণি হিসেবে পরিনত হন। স্থানীয় কবি ও লেখকদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সৌরভ সংঘ’। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাহিত্য পরিষদ’। এরপর তিনি ‘ময়মনসিংহরে ইতিহাস’ নামে একটি আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশ করেন ‘ময়মনসিংহরের বিবরণ’ এবং এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৯০৭ সালে। ‘ময়মনসিংহরে ইতিহাস’ ও ‘ময়মনসিংহরের বিবরণ’ রচনা করেন তিনি একজন নামকরা ইতিহাসবিদের খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ‘ময়মনসিংহের কাহিনী’ ও ‘ময়মনসিংহ পল্লী বিবরণ নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দুটি বইয়ের কোন হদিস এখনও পাওয়া যায়নি। নিজ জেলার বাইরেও তিনি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি রচনা করেন ‘ঢাকার বিবরণ’ এছাড়া তিনি ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামে একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে ‘ফরিদপুরের বিবরণ’ নামের ইতিহাস গ্রন্থটির কোন সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। বাংলা ১৩১৫ সালে রচনা করেন ‘সারস্বত কুঞ্জ’ নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ। ১৯১৭ সালে রচনা করেন বাঙলা ‘সাময়িক সাহিত্য’ গ্রন্থটি। পরবর্তীতে অনেক গবেষক এ বইটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন।

কেদারনাথ মজুমদার জীবনে চারটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ১৮৮৮ সালে যে ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটির নাম পরিবর্তন করে ‘প্রফুল্ল’ নামে প্রকাশ করেন। ‘স্রোতের ফুল’ উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ১৮৭৭ সালের নোয়াখালী জেলার প্লাবনের(বন্যার) করুন কাহিনী। বাংলা ১৩৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘শুভদৃষ্টি’ উপন্যাস এবং ১৩৩১ সালে প্রকাশ করেন ‘সমস্যা’ উপন্যাস। তিনি ‘দস্যুর মহত্ত্ব’ ‘সপ্ন’ ও ‘ঋণ পরিশোধ’ নামে তিনটি ক্ষুদ্র উপন্যাস লিখিছিলেন। এ তিনটি উপন্যাসকে সমষ্টি করে ১৯০৬ সালে জুলাই মাসে প্রকাশ করেন ‘চিত্র’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।

রামায়ন নিয়ে গবেষণাঃ
বাংলা ১৩১০ সাল থেকে কেদারনাথ মজুমদার সনাতন(হিন্দু) ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘রামায়ন’ মহাকব্যকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে সে সময় রামায়ন নিয়ে গবেষণা করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। তিনি ‘রামায়ন’ কে একটি ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক গ্রন্থ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। রামায়নের উপর গবেষনা স্বরূপ তিনি ‘রামায়ন সমাজ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যে বইটি তার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রকাশ হয়েছিলো।

মৃত্যুঃ
‘রামায়ন সমাজ’ গ্রন্থটি রচনা করার সময় কেদারনাথ মজুমদার খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মোহাম্মদ কাশেম

প্রাথমিক পরিচয়ঃ

মোহাম্মদ কাশেম ছিলেন সাংবাদিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, রেডিও ব্যক্তিতব ঔপন্যাসিক। সমাজের অবহেলিত ও নিপেড়িত মানুষের বন্ধু। সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনায় ছিল তার অন্যবদ্য অবদান। চল্লিশের দশকের সাহিত্য ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি পরিচিত নাম। রেডিওতে নাটক, কবিতা সহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্টান করে তিনি ঐ সময় খুবই জনপ্রিয় হন। মোহাম্মদ কাশেম যে নামটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কালের শ্রোতে। বর্তমান সমাজে যে নামটি আজ রয়ে গেছে পাঠকের আড়ালে। 

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ

মোহাম্মদ কাশেম কুমিল্লা শহরে ১৯০৫ সালে পিতার কর্মস্থলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম  সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন মায়ের নাম শাহের বান্নু খানম। তার বাবা ছিল স্কুলের শিক্ষক। তিনি ছিল একজন মৌলভী। আরবি, ফার্সিতে তিনি ছিল পণ্ডিত, তার পূর্ব পুরুষের বসতি ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশে। পরে তিনি তৎকালীন ত্রিপুরা ( বর্তমান কুমিল্লা) এসে বসতি গড়েন। তার বাবা জীবনে দুটি বিয়ে করেন। মোহাম্মদ কাশেম ছিল তার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান। এছাড়া ১ম ঘরে মোহাম্মদ কাশেম এর আরও চার ভাই রয়েছে। এরা হলেন মোহাম্মদ সৈয়দ, সৈয়দ ইয়াসিন, মোহাম্মদ হাসেম, মোহাম্মদ নাজেম ও মোহাম্মদ তামেজ। 

শিক্ষা জীবনঃ 

মোহাম্মদ কাশেমের পরিবারের সবাই ছিল শিক্ষিত। তার বাবা পড়ালেখার প্রতি ছিল খুবই আগ্রহী। তাই তার বাবা মোহাম্মদ কাশেমকে বাল্য শিক্ষা দেন। এরপর তাকে ভর্তি করেন কুমিল্লা শহরে একটি স্কুলে যেখানে তার বাবা নিজে চাকরি করেন। তার বাবার সাথে তিনি স্কুলে যান। ক্লাসের শিক্ষকরা তাকে খুবই ভালবাসতেন ও আদর করতেন কারন সে ছিল খুবই ভাল ছাত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রবেশিকা পরীক্ষার পূর্বে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবার মৃত্যুতে তার সংসারের আসে চরম অভাবের কারনে তিনি পড়ালেখা ছেড়েদেন। এখানেই তিনি লেখাপড়ার ইতি টানেনে।  

কর্ম জীবনঃ

মোহাম্মদ কাশেমের বাবার মৃত্যুর পর সংসারে অভাব দেখা দিলে তার মা সাহের বানু তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে মোহাম্মদ কাশেম একটি দোকানে কোন রকম বেতনে চাকরি নেন। এই বেতনে কোন মতেই সংসার চলতনা। তাই তিনি চরম দুঃখ, দারিদ্রতা নিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯২৩ সালে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি পানি খেয়ে রাস্তায় ঘুমাতেন। এরপর কিছু দিন পর তিনি পত্রিকা বিক্রি করেন। ১৯২৬ সালে তিনি আবার ঢাকায় এসে নিজেই ছোট একটি দোকান দেন। এরপর তিনি পত্রিকার সম্পাদনার সাথে জড়িত হন। এখানেও কিছু না করতে পেরে একটি ষ্টেশনারী দোকানে স্বল্প বেতনে চাকরি নেন। ১৯২৯ সালে আবার চাকরি ছেড়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় তিনি কিছুদিন হকারি করে দিন কাটান। 

বিবাহ বন্ধন ও পারিবারিক জীবনঃ

মোহাম্মদ কাশেম ১৯২৯ সালে ঢাকার মেয়ে খাইরুল নেমাকে বিয়ে করেন। ১৯৩১ সালে মোহাম্মদ কাশেমের ও খাইরুল নেমার ঘরে আসে আব্দুল কাইউম। তখন মোহাম্মদ কাশেম ও খাইরুল নেম ছিল কলকাতায়। ১৯৩৩ সালে জন্ম নেয় ২য় সন্তান আবু তাহের। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেয় ৩য় সন্তান হাবিবুর রহমান। ১৯৩৯ সালে যখন মোহাম্মদ কাশেম ঢাকায় চলে আসেন তখন জন্ম নেয় তার ৪র্থ সন্তান হাজেরা খাতুন। ১৯৪৫ সালে জন্ম নেয় ৫ম সন্তান জামেলা খাতুন খাইরুল নেমাকে বিয়ের পর মোহাম্মদ কাশেমের জীবনে আসে পরিবর্তন। তারা দুজনের দম্পতি জিবন ছিল সুখের। যদিও শত দরিদ্র ও তাদের জীবনে ভাঙন ধরাতে পারেনি। বরং এ দারিদ্রতার মাঝেও খাইরুল নেমা তাকে প্রেরনা দিয়েছেন বড় হওয়ার জন্য। 

সাংবাদিক জীবনঃ

মোহাম্মদ কাশেমের কলকাতায় গিয়ে পত্রিকা বিক্রি করতেন তখন থেকে তিনি পত্রিকার প্রতি একটু আনুরাগি ছিল। কলকাতা থেকে ঢাকা ফেরার পর ১৯২৬ সালে তিনি ‘ দরিদ্র’’ পত্রিকায় চাকরি থাকা অবস্থায় তিনি নিজে ‘ অভিযান নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। এই পত্রিকাটির নাম দেন কাজী নজরুল ইসলাম। কিছু দিন পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে ‘ সোলতান’’ নামের একটি পত্রিকায় চাকরি নেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের অতি নিকটে আসেন। সোলতান পত্রিকা বন্ধ হলে তিনি ‘ বেদুইন’ পত্রিকার সহ সম্পাদক হিসেবে যোগদেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ‘সবুজপত্র’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন । মোহাম্মদ কাশেম এক সময় ‘ সওগাত’ পত্রিকায় জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েন। 

সাহিত্যিক জীবনঃ 

মোহাম্মদ কাশেমের সাহিত্যর ক্ষেত্রে উন্ন্যেস ঘটে যখন তিনি দরিদ্র ও অভিযান পত্রিকায় সম্পাদনায় ছিলেন। ঐ সময় তিনি দরিদ্র ও অভিযান পত্রিকায় প্রচুর লেখতেন। ১৯২৮ সালে সংগত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘ মহা কবি হাসমান- বিন- সাবেত নামে একটি প্রবন্ধ। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘ কবি ইমরুল কায়েসের নামে আরও একটি বিশেষ প্রবন্ধ। একই বছর ‘ মহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘ বারোয়ারী উপন্যাস’’ নামে একটি গ্রন্থ কিস্তিতে বের হতে থাকে। এছাড়া ঐ বছর প্রথম অংশ প্রকাশিত হয় ৩য় বর্ষ সংখ্যা। ১৯৩৩ সালে বের হয় তার ২য় উপন্যাস আগামী বারে সমাপ্য। একই বছর অভিযান পত্রিকায় বের করে ‘ ধান ক্ষেত’ নামে একটি পুস্তক। ১৯৩৯ সালে বের হয় ‘ আধুনিক বাংলা সাহিত্য মুসলমান’’ ।  ১৯৪৩ সালে মোহাম্মদ কাশেম বাঙ্গালী পত্রিকায় প্রকাশ করেন ছোট গল্প ‘ পুনরাবৃত্তি’’ । ১৯৪৮ সালে আরবি কাব্যর ২য় অংশ প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকায়। ১৯৪৯ সালে ‘ চিড়িয়া উড় গেয়ি’’ নামক একটি গল্প বের হয় পাকিস্থান পত্রিকায়। ‘ চকবাজারের কালুভাই’’ একটি করুন গল্প বের হয় ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট পঞ্চায়েত পত্রিকায়। 

বেতার নাটক ও অন্যান্য অনুষ্টানে মোহাম্মদ কাশেম

১৯৪০ সালে দিকে মোহাম্মদ কাশেম ওল ইন্ডিয়া রেডিও এর সাথে সম্পৃক্ত হন। ঐ সময় তিনি রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন অনুষ্টান সম্প্রচার করতেন। সংবাদ পাঠকের জন্য তিনি সংবাদ লিখে দিতেন। তিনি রেডিওতে বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি করতেন। নবীদের ধারাবাহিক জীবনী নিয়ে তিনি ‘ নবী কাহিনী’ নামে একটি কাহিনী লিখেন এবং টা রেডিওতে প্রচার করে তৎকালীন মুসলিম সমাজে আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। রেডিওতে প্রচারের জন্য তিনি ১৯৪২ সালে ‘ সোহরাব রুস্তম’’ ও ‘ মনসুর ডাকাত’ নামে দুটি নাটক লিখেন। যা পরে রেডিওতে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার হয়। ১৯৪৭ সালে ‘ যারা কাঁদে’ নামক আরেকটি ফিচার নাটক লিখে যা পরে রেডিওতে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার হয়। ১৯৪৮ সালে ‘ শতাব্দীর আলো’ নামে  একটি নাটক রচনা করেন এবং গ্রামোফোনে রেকর্ড করে বাজারে বিক্রি করেন। 

প্রকাশনা শিল্পে মোহাম্মদ কাশেম

১৯৩৯ সালে মোহাম্মদ কাশেম ‘ মখদুমি লাইব্রেরী এন্ড আহসানউল্লাহ বুক হাউস এর ঢাকা শাখার ম্যনেজার নিয়োগ হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভঙ্গ হয়ে গেলে ‘ মখদুমি লাইব্রেরী এন্ড আহসানউল্লাহ বুক হাউস এর মালিক এটি বিক্রি করার সিধান্ত নেন। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ কাশেম এটি নিজি ক্রয় করে নতুন নামে চালু করেন। তিনি এটির নাম দেন ফরাজ দিল প্রকাশ’। এরপর তিনি পুস্তক প্রকাশনায় ব্যপক সাফল্য লাভ করেন। তার প্রকাশনায় বের হয় দীনেশ চন্দ্র সেনের প্রাচিন বাংলার সাহিত্য মুসলমানদের অবদান, মুজিবুর রহমান খানের পাক ভারতের ইতিহাস সম্ভলিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘নয়া তারিখ’’ সৈয়দ আলী আহসান রচিত Our lteritage’১৯৪৯ , মুসলিম রেনেসার কবি ফররুখ আহমেদ রচিত পাঠ্য বই ‘ নয়া জামাত’’ সহ অনেক নামকারা লেখকের বিখ্যাত বই সমূহ। ফলে প্রকাশনা শিল্পে মোহাম্মদ কাশেমের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মোহাম্মদ কাশেমের প্রকাশনায় প্রকাশিত বিয়ের প্রচ্ছদ আঁকতেন শিল্পাচয জয়নুল আবেদীন , পটুয়া কামরুল ইসলাম সহ বিখ্যাত শিল্পীরা। 

সামাজিক কর্মকাণ্ডঃ

 মোহাম্মদ কাশেম জীবনে দারিদ্রতা কাকে বলে হারে হারে টের পান। তায় সমাজের দারিদ্রদের জন্য তার মন সর্বদায় কাঁদতেন। ১৯৪১ সালে দাঙ্গায় চরম আর্থিক সংকটে দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ না খেয়ে মারা যেত। তাই তিনি ঐ সময় দাঙ্গা কবনিতে মানুষের সাহায্যর জন্য ‘ নওজোয়ান ক্লাব’ নামে একটি সেবা মূলক প্রতিষ্টান করেন। এই প্রতিষ্টান থেকে গরীব দুস্থ মানুষকে সাহায্য করা হত। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় তাদের সম্পর্কে লেখে তাদের সাহায্যর জন্য সম্পদশালিদের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৪৫ সালে ২য় বিশ্ব যুব্দের সময় তিনি স্থানীয় সম্পদশালিদের নিয়ে A R P( Air Raid Precuation) নামে একটি সেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে মোহাম্মদ কাশেম ঢাকার রহমতগঞ্জ স্থানীয় লোকদের নিয়ে ‘’ রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি’’ (রহমতগঞ্জ ক্লাব) প্রতিষ্টান করেন। এবং এর প্রতিষ্টানকালীন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি তৎকালীন সময়ে শিক্ষা সংস্কৃতি সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেন। 

সন্মাননা ও স্বীকৃতিঃ 

মোহাম্মদ কাশেম জীবনে পেয়েছেন বহু পাঠকের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। তিনি কাজ করেছেন মানুষের জন্য নিজের স্বীকৃতির কথা কোন দিন চিন্তা করেনি। মোহাম্মদ কাশেম জীবনে কোন পুরষ্কার পায় কিনা জানা যায়নি। 

মৃত্যুঃ 

মোহাম্মদ কাশেম মৃত্যুর পূর্বে প্রচুর অর্থ সংকটে ভুগেন। এছাড়া ঐ সময়ে তার স্বাস্থ্যও ভাল যাচ্ছিলনা । অবশেষে ১৯৫৭ সালে ২২ শে নভেম্বর মোহাম্মদ কাশেম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

গিরিশ চন্দ্র সেন

প্রাথমিক পরিচয়ঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। ব্রাক্ষ্যধর্ম প্রচারক ও সাংবাদিক। তিনি হলেন ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধ্রমগ্রন্থ ‘ কোরআন শরিফের’ ১ম বাংলা অনুবাদক। তার এই অনুবাদ গ্রন্থের জন্য ত্যকালিন মুসলমান সমাজ কুরআন শরিফের বাংলা ভাষায় পড়তে পেরেছিলেন। শুদু মুসলমান সমাজই নয় সকল ধর্মের লোকই কুরআন শরিফের বাংলা ভাষায় পড়তে পেরেছিলেন। তিনি শুধু কোরআন শরিফের’ ১ম বাংলা অনুবাদক নয়। ইসলাম ধর্মের বহু হাদিসেরও বাংলা অনুবাদ করেন। তিনি কোরআন শরিফের’ ১ম বাংলা অনুবাদ না করলেও অনুবাদ হতো কিন্তু সেটা কত বছর পর হতো সেটা কে জানত। গিরিশ চন্দ্র সেন বাংলায় কোরআন শরিফের’ অনুবাদ করার পর অনেকেই কোরআন শরিফের অনুবাদ করার অনুপ্রানিত হয় কাজ শুরু করে দেন।

জন্ম ও পরিচয়ঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন কোরআন শরিফের’ ১ম বাংলা অনুবাদক তিনি ১৮৩৫ সালে ত্যকালিন ঢাকা জেলার পাচদোনা ( বর্তমান নরসিংদী জেলার ) জন্ম গ্রহণ করেন। গিরিশ চন্দ্র সেন
এর পিতার নাম ছিলেন মাধব রায় ও ।তার পূর্ব পরুষ ছিল নবাবের দেওয়ান। দর্পনারায়ন ফার্সি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। তার পূর্ব সূত্রে চলে আসে গিরিশ চন্দ্র সেন এর পর্যন্ত। তায় তিনি ছোট বেলা থেকেই ফার্সি ভাষা জানতেন। সেন পরিবার তখন ঢাকা জেলার বিখ্যাত ছিলেন। সেন বংশের আদি পুরুশগণ মালদহ জেলার আদিবাসী ছিলেন। প্রবর্তিতে পাচদোনায় এসে বসতি গড়েন।

পরিবার পরিচিতিঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন এর পিতা মাধব রায় সেন তিনি ছিলেন ঐ সময়ে নামকরা ফার্সি ভাষার পণ্ডিত। মাধব রায়ের পিতার নাম ছিল রামমোহন সেন। মাধব রায়ের চাচার নাম ছিল দর্পনারায়ন রায়। তিনি ছিলেন নবাবা মুর্শিদকুলি খাঁর দেওয়ান। তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর রাজ দরবার থেকে রায় উপাদিতে ভূষিত হন। গিরিশ চন্দ্র সেনরা ছিল ৩ ভাই তবে তাদের কোন বোন ছিল কিনা তা জানা যায়নি। তার বড় ভাইয়ের নাম ছিল ঈশর চন্দ্র সেন,মেঝ ভাই হরচন্দ্র সেন ও ছোট ছিল তিনি নিজেই। তার পরিবার ছিল খুবই প্রতাপশালী। তিন ভাই ও মা বাবা নিয়ে ভালই ছিলেন। তিনিও ভাল ভাবেই বেড়ে উঠেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র ১০ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। বাবার মারা যাওয়াতে পরিবার অভিবাবকহিন হয়ে পড়েন। এই সময় তার বড় ভাই সংসারের হাল ধরেন।

শিক্ষা জীবনঃ

গিরিশ চন্দ্র সেন এর পরিবারের সবাই ছিলেন শিক্ষিত ও ফার্সি পণ্ডিত। তাই তার পরিবার থেকেই তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। প্রথমে তিনি কলাপাতায় লিখে বাংলা বর্ণমালা শিখেন। গিরিশ চন্দ্র সেন এর বয়স যখন ৭ বছর সে সময় তার বাবা তাকে ফার্সি ভাষা শেখাতে শুরু করেন। এরপর আরবি শেখার জন্য ব্যবস্তা করেন একজন মৌলভীর। বাংলা, ফার্সি, আরবি একসাথে চলতে থাকে। কিন্তু তিনি আরবির চেয়ে ফার্সি ভাষায় বেশি পারদর্শী ছিলেন। কারন পরিবারের সকলেই ছিল ফার্সি ভাষার পণ্ডিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র ১০ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। বাবার মারা যাওয়াতে পরিবার অভিবাবকহিন হয়ে পড়েন। এই সময় তার বড় ভাই তার অভিবাভকের দায়িত্ব পালন করেন। তার বড় ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল গিরিশ চন্দ্র সেনকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার। ঠিক তায় করেন তিনি। গিরিশ চন্দ্র সেনকে ভর্তি করেদেন ঢাকার পোগজ স্কুলে। কিন্তু পোগজ স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্তা তার কাছে ভাল লাগেনি। একদিন তিনি দেখেন তার সহপাঠীকে শাসনের দলে চরম নির্যাতন করা হচ্ছে। তখন ছাত্রদের পড়ালেখার সময় তাদের বেত মারা ছিল একটি কালচার। এর ফলে অনেক ছাত্রগন স্কুল ছেড়ে চলে আসতেন। গিরিশ চন্দ্র সেন এর ক্ষেত্রে একই অবস্থা হন। স্কুলের শিক্ষকদের শাসনের ফলে তিনি পোগজ স্কুল ছেরে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। তারপর বাড়িতেয় তার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এর জন্য কৃষ্ণচন্দ্র নামের একটি ফার্সি পণ্ডিত রাখা হয়। সেখানে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রর কাছে ফার্সি ও বাংলা শিখেন। পাশাপাশি তার কাছে বিভিন্ন ধরনের ফার্সি বই পড়েন। যার ফলে তিনি সাহিত্যর প্রতি কিছুটা প্রেরনা পান। ১৮৫২ সালে গিরিশ চন্দ্র সেন এর ছোট দাদা তাকে ময়মনসিংহে নিয়ে যান। সেখানে তাকে এক মৌলভির কাছে ভর্তি করে দেন পার্থ ভাষা শেখার জন্য। এরপর তিনি সংস্কৃতি ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ হন। ১৮৫৩ সালে সংস্কৃতি ভাষা শেখার জন্য একটি সংস্কৃতি বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ……………।স্কুলে । এখান থেকে তিনি কৃতৃত্বের সাথে পাশ করেন। ১৮৭৬সালে আরবি শেখার জন্য তিনি লক্ষৌ যান তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর। তিনি সেখানে তিনি আরবি, ব্যকরন ছাড়া ও দিওয়ান –ই – হাদিসের পাঠ করেন। ১বছর আরবি পড়ার পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে আবার তিনি আরবি পড়ার জন্য মৌভির কাছে ভর্তি হন। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে তিনি মৌল্ভী আলিম উদ্দিনের কাছে আরবি ইতিহাস ও আরবি সাহিত্যর উপর তিনি পড়ালেখা করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি একটি কুরআন শরিফ কিনেন। তবে সে সময় ব্রাক্ষ্নের কাছে কেও কুরআন শরিফ বিক্রি করত না। তায় তিনি তার বন্দুর মাধ্যমে একটি কুরআন শরিফ কিনেন। শুরু করে দেন কুরআন চর্চা। অনেক ঘঠনার পর তিনি কুরানের তরজমা আয়ত্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি কুরানের বাংলা অনুবাদ করেন।

বিবাহ বন্ধন ও পারিবারিক জীবনঃ
১৮৫৭ সালে গিরিশ চন্দ্র সেন বিবাহ বন্দনে আবব্দ হন। তার স্ত্রীর নাম ব্রাক্ষময়ী দেবী। ব্রাক্ষময়ী দেবীর বাবা ছিল নরসিংদীর জমিদার। গিরিশ চন্দ্র সেন যখন বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর এবং তার স্ত্রীর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। বিয়ের প্রায় ১০ বছর পর গিরিশ চন্দ্র সেন ব্রাক্ষধর্মে দীক্ষিত হন। তবে তিনি তার স্ত্রিকে তার শুশুর বাড়িতে রাখেন। পরবর্তীতে তার স্ত্রীর অনুরুধে তাকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসেন। ব্রাক্ষধর্মে নেয়ার ফলে তাকে বাসা পেতে অনেক কষ্ট করতে হন। তার এক বন্দুর মাধ্যমে কোনরকম একটু আশ্রয় পান। এসময় তার পরিবারে খুব অভাব ছিল। অভাব অনটনের মাধ্যমেও তাদের পরিবার সুখেরই ছিল। একসময় তাদের ঘরে আসে এক কন্যা সন্তান। জন্মের ১৫ দিনের মাথায় কন্যা সন্তান মারা যায়। ১৮৭০ সালে তার স্ত্রীও মারা যান। স্ত্রী মারা যাওয়ার ১২/১৩ বছর পূর্বে তার ছোট দাদা মারা যান। ভাই, সন্তান, স্ত্রীকে হারিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে পড়েন। এ শোক কাটানোর জন্য তিনি ধর্মের প্রতি বেশী দুর্বল হয়ে পড়েন। এবং ব্রাক্ষধর্মে প্রচার শুরু করেন।

চাকরি জীবনঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন এর কর্ম জীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালে ছোট দাদার সাথে ময়মনসিংহে আসার পর। এখানে তিনি পকল নিবিসে চাকরি করেন। এতে বেতন ছিল কিমি. যা দিয়ে তার খাওয়া দাওয়া কোনরকম হত। পরেতিনি চাকরি ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল পাশ করার পর তিনি ময়মনসিংহের জেলা স্কুলের দ্বিত্বয় পণ্ডিত হিসেবে যোগদেন। এসময় তিনি এর পাশাপাশি ‘ ঢাকা প্রকাশনী’ পত্রিকায় ময়মনসিংহের প্রতিনিধি ছিলেন। গিরিশ চন্দ্র সেন কলকাতায় ভারত শ্রমে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। সেখানে তিনি সাহিত্য ও ব্যকরন শিক্ষা দিতেন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত করেন। স্ত্রী মৃতুর পর তিনি সংসারের প্রতি আনিহা হয়ে পড়েন। তায় তিনি এই শোক থেকে মুক্তির জন্য ধর্ম প্রচার ও সাহিত্য রচনায় নিজেকে মনোনিবেশ করেন।

ব্রাক্ষধর্ম গ্রহণ ও প্রচারঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন ব্রাক্ষধর্মের প্রতি অনুরাগী হন ময়মনসিংহে মুড়াপারার জমিদার রামচন্দ্র বন্ধোপাধ্যায় এর কাছ থেকে। ১৮৬৫ সালে কেশব চন্দ্র সেন ময়মনসিংহে এসে ব্রাক্ষধর্মের প্রতি অনেককে অনুপ্রেরনা দেন। ১৮৬৭ সালে ময়মনসিংহে আসেন ব্রাক্ষধর্মে প্রচারক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছ থেকে ব্রাক্ষধর্মের প্রতি গিরিশ চন্দ্র সেন তালিম নেন। এরপর গিরিশ চন্দ্র সেন ব্রাক্ষধর্মের প্রতি আগ্রহ হন। এরপর তাকে বাড়িওলা তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন। হিন্দু, মুসলিম, সবার কাছেই বিরাগভাজন হন। তাকে আর কেও বাসা ভাড়া দিতে চাননি। এমন কি তার স্ত্রী আন্তস্তা হয়ার পর কেও আসেনি। একসময় তাদের ঘরে আসে এক কন্যা সন্তান। জন্মের ১৫ দিনের মাথায় কন্যা সন্তান মারা যায়। ১৮৭০ সালে তার স্ত্রীও মারা যান। স্কুল পাশ করার পর তিনি ময়মনসিংহের জেলা স্কুলের দ্বিত্বয় পণ্ডিত হিসেবে যোগদেন। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে নিজেকে সম্পূর্ণ রুপে ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত করেন।এরপর তিনি যাযাবর রূপ ধারন করেন। ১৮৭৪ সালে কলকাতায় গমন করেন। ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি উড়িষ্য, আসাম,উত্তর বঙ্গ, মধ্য ভারত, মাদ্রাজ, সহ অনেক স্থানে ভ্রমণ করেন। এরপর গিরিশ চন্দ্র সেন তার গুরু ব্রাক্ষধর্মের প্রধান কেশব চন্দ্র সেনের কাছ থেকে ধর্ম প্রচারক হিসেবে উপাধিপান। এরপর তিনি কিছু সময় ময়মনসিংহে অবস্থান করেন। তবে তিনি ব্রাক্ষধর্মে প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। ১৮৭৫/৭৬ সালের দিকে ব্রাক্ষধর্মে ব্যক্তিরা হিন্দু, খৃষ্টান, ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ গুলো বাংলায় অনুবাদ করার জন্য সিধান্ত নেন। তাদের ধারনা ছিল সকল ধর্ময় শান্তি চায়। তায় তারা ৪ ধর্মকে একত্রিত করে ধর্ম প্রচার করেন। গিরিশ চন্দ্র সেন আরবি ও ফার্সি জানতেন। তায় ইসলাম ধর্মের পবিত্র কোরআন শরিফ অনুবাদের জন্য গিরিশ চন্দ্র সেনকে দায়িত্ব দেন। এর জন্য ভাল করে আরবি শিক্ষার জন্য ১৮৭৬ সালে ১২ বছর বয়সে ……………থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে তিনি ঢাকায় এসে কোরআন শরিফ অনুবাদ শুরু করেন।

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন মোটামোটি সাহিত্যিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেন। গিরিশ চন্দ্র সেন এর বয়স যখন ৭ বছর সে সময় তার বাবা তাকে ফার্সি ভাষা শেখাতে শুরু করেন। এরপর আরবি শেখার জন্য ব্যবস্তা করেন একজন মৌলভীর। বাংলা, ফার্সি, আরবি একসাথে চলতে থাকে। কিন্তু তিনি আরবির চেয়ে ফার্সি ভাষায় বেশি পারদর্শী ছিলেন। কারন পরিবারের সকলেই ছিল ফার্সি ভাষার পণ্ডিত।গিরিশ চন্দ্র সেন এর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে আসারপর তিনি প্রথম কবিতা দিয়েয় তার সাহিত্যিক জীবন শুরু করেন। ঢাকায় প্রকাশিত ……………।পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। গিরিশ চন্দ্র সেন এর প্রথম গ্রন্থের নাম ‘ বনিতা বিনোদ’’। ১৮৫৫ সালে এটির কিছু অংশ বিভিন্ন স্কুলের পাথ্যপুস্তকে স্বীকৃতি লাভ করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি প্রকাশ করেন জীবনী গ্রন্থ ‘ ব্রাহ্মময়ী- রচিত। ১৮৮০ সালে তিনি কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি চ১৮৮৫ সালে মহানবী হজরত মুহাম্মদ ( সঃ) এর জীবনী নিয়ে প্রকাশ করেন ‘ মহা পুরুষ জীবনী চরিত্র ২’’। ১৯০৬ সালে প্রকাশ ‘ মহাপুরুশ মুহাম্মদ ও ত্য প্রবর্তিত ইসলাম ধর্ম। ঐ সময় তার এই গ্রন্থ গুলো ব্যপক ভাবে প্রচলন হয়ে উঠে ও তার সুনাম অর্জন করেন। সবার ধারনা তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম পবিত্র গ্রন্থ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেন। কিন্তু তার জিবনে বেশীর ভাগ গ্রন্থই ইসলাম ধর্মের ও ধর্ম গুরুদ্গের নিয়ে বিভিন্ন জীবনী লেখেন। গিরিশ চন্দ্র সেন জিবনে ৩৩ টি গ্রন্থ রচনা করেগেছেন। এর মধ্যা ২২ টি গ্রন্থ ছিল ইসলাম ধর্ম নিয়ে। তবে অনেকের মতে তার বইয়ের সংখ্যা ৪০ টির বেশী হবে। তিনি জিবনে বেশ কয়েকটি পত্রিকার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। ১ম জিবনে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকার ময়মনসিংহের প্রতিনিধি ছিলেন। নারী পত্রিকার ‘ পরিচারিকা’ পত্রিকা প্রাকাশে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিল। তিনি ‘ বঙ্গ বন্ধু’ ও ‘ সুলভ ও সমচার’ পত্রিকার সহযোগী অধঅ্যাপক হিসাবে ছিলেন। নারী জাতীর জাগরণের জন্য তিনি ‘ মহিলা’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এটিতে তিনি ১২ বছর সম্পাদনা করেন। ১৯০৯ সালে প্রকাশ করেন ইমাম হাসান ও হোসেনের জীবনী। একি বছর তিনি ইসলামের ৪ খলিফা জীবন বৃতান্তনিয়ে ‘ চারিজন ধর্ম নেতে’

১ম কোরআন শরিফের অনুবাদকঃ
যে জিনিসটির জন্য গিরিশ চন্দ্র সেন ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বেশী পরিচিত সেটি হচ্ছে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ। অনেকের মতে তার পূর্বে কেউ কেউ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেন। তবে কেউ গিরিশ চন্দ্র সেন এর আগে অনুবাদ করে থাকলেও স্মবত তারা পূর্ণাগ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করতে পারেনি। তাই আমরা গিরিশ চন্দ্র সেনকে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদক হিসেবে ধরে নিতে পারি। তবে এটি এখন সর্বজন স্বীকৃত। ব্রাক্ষধর্মের গুরু কেশব সেনের অনুপ্রেরনায় তিনি কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ শুরু করেন। তবে ঐ সময় এ ধরনের একটি কাজ করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। কারন যেকোন ধর্মের গ্রন্থের অনুবাদ করা ছিল এক ধরনের মহামান। ধর্ম মতে তাকে চরম বেমান বলা হত। কিন্তু তিনি ঐ সময় রক্ষণশীল সমাজকে তোয়াক্কা করেনি। শুরু করে দেন কোরআন চর্চা। ১৮৮১ সালে ১২ ডিসেম্বর তিনি কোরআন শরিফের ১ম খণ্ড প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশ হয় শেরপুরে চারু প্রেশ থেকে। এরপর তিনি কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ এর বাকি অংশ প্রকাশ করেন কোলকাতার বিধমন যন্ত্রে। কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ মোট ১২ টি খণ্ডে প্রকাশ হয়। অনুবাদ শেষ হয় ১৮৮৬ সালে । ১৮৮৬ সালে তিনি ১২ টি খণ্ডকে একত্র করে কোরআন শরিফের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন।

স্ত্রী শিক্ষায় গিরিশ চন্দ্র সেনের অবদানঃ
স্ত্রী শিক্ষায় গিরিশ চন্দ্র সেন এর অবদান কম নয়। স্ত্রী শিক্ষার জন্য নরসিংদীর পাচদোনায় এবং ময়মনসিংহে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি নারী শিক্ষার জন্য একটি অবৈতনিক কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজে তিনি নিজেই পড়াতেন। তবে এর জন্য তিনি কোন বেতন নিতেন না। ( বামতোপনি ) নামক নামক একটি নারিবান্ধব পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। পরিচারিকা নামক একটি নারী পত্রিকা প্রকাশে তিনি অন্যতম ভূমিকা রাখেন। তিনি ‘ মহিলা’’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রায় ১২ বছর পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তার শেষ জিবনে তিনি অসহায় নারিদের জন্য তার সম্পত্তির ১২ আনাই তাদের জন্য দান করে দেন।

বঙ্গ ভঙ্গে ও গিরিশ চন্দ্র সেনঃ
১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ হয় তিনি এর পক্ষে ছিলেন। তিনি চিন্তা করে দেখেন মুসলমান সমাজ হিন্দু সম্প্রদায় দ্বারা নির্যাতিত। তারা মাথা তুলে দাড়াতে পারছেনা। যদি বঙ্গ ভঙ্গ হয় তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজ মাথা তুলে দাড়াতে পারবে। এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ ‘’ পূর্ব বঙ্গের কল্যাণ হবেই’’’ যে দেশে নানা বিষয়ে পশ্চাৎগামী ও অনুন্নত, এখন হতেই অগ্রসর হবে।……………।আমার জন্ম ঢাকায় সেখানে আমার বাসগৃহ আমি ঢাকার নিবাসী। ঢাকা রাজধাণী হল এতে অনেক উন্নত হল। ইহাতে আমার দুঃখ লইয়া আনন্দ হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি হিন্দু হয়েও মুসলমানদের কল্যাণ চেয়েছেন। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ তিনি সপ্নে এঁকেছিলেন।

আলোচনা / সমালোচনাঃ
কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করে তিনি ঐ সময় একজন আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। চারদিক থেকে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ঘরের সন্তান। কিভাবে তিনি কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করতে পারেন। তিনি শুদু কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেনি। তিনি কিন্তু তার জিবনে বেশীর ভাগ গ্রন্থই ইসলাম ধর্মের ও ধর্ম গুরুদ্গের নিয়ে বিভিন্ন জীবনী লেখেন। গিরিশ চন্দ্র সেন জিবনে ৩৩ টি গ্রন্থ রচনা করেগেছেন। এর মধ্যা ২২ টি গ্রন্থ ছিল ইসলাম ধর্ম নিয়ে। এর জন্য তিনি হিন্দু সমাজ থেকে পেয়েছেন অপবাদ ও মুসলমান সমাজ থেকে পেয়েছেন সাধুবাদ। তবে অনেক মুসলমান ও তাকে কম তিরস্কার করেনি। এইসকল আলোচনা থেকে রক্ষা পেতে তিনি প্রথমে ছদ্ম নামে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। মাওলানা আকরাম খাঁ গিরিশ চন্দ্র সেন কর্তৃক কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদকে ( জগতের অষ্টম আশ্চর্য ‘’ বলিয়া প্রকাশ করেন। তিনি কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করাতে মুসলমান সমাজ দ্বারা ‘’ মোল্ভী” পদবী পান। এরপর ব্রাহ্ম সমাজ থেকে তাকে ‘’ ভাই’’ উপাদিতে ভূষিত করেন। এজন্য তাকে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন বলা হয়। গিরিশ চন্দ্র সেন কর্তৃক কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ হওয়ায় তার এক বন্দু বলেন ‘’ জনেক কাদের আমাদের কোরআন পাক অনুবাদ করতেছে হাতে পেলে গর্দান নিতাম’’ নারী শিক্ষার অবদানের জন্য বাঙ্গালী নারী সমজ তাকে পিত্র বলে সম্বোদন করেন। তবে কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করার ফলে কারো কারো কাছ থেকে সমালোচিত হলেও এ কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ তাকে সাফলোর শীর্ষে পৌছে দেন।

মৃত্যুঃ
গিরিশ চন্দ্র সেন জীবনের শেষ সময় কোলকাতায় তার ভাগ্নে বিখাত্য আইনজীবী ( গাজীপুরের সন্তান) কে, জি, গোপ্তের বাসায় থাকতেন। তার বয়স যখন ৭৫ বছর সে সময় তিনি আস্তে আস্তে অসুস্ত হতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারতেন মৃতু তাকে দুয়ারে এসে হাতছানী দিচ্ছে। তায় তিনি নিজ গ্রামে নরসিংদী পাচদোনায় ফিরে আসেন। ১৯১০ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। আসুস্ততার কারনে তাকে পাচদোনায় না নিয়ে ঢাকার বাসায় নিয়ে আসেন। ১৯১০ সালে ১৫ আগস্ট তিনি ঢাকার বাসায় মৃতুবরন করেন। মৃতুর পর তাকে তার নিজ গ্রামে পাচদোনায় সমাহিত করা হয়।

শহীদ সাবের

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক শহীদ সাবের ১৯৩০ সালে বর্তমান কক্সবাজার জেলার ঈদগাও এলাকায় সোনাপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার স্কুলের সার্টিফিকেটে নাম ছিল এ,কে, এম শহিদুল্লাহ। পড়ে তিনি সাহিত্য সমাজে শহীদ সাবের নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার বাবার নাম সালামতউল্লাহ ও মায়ের নাম শফিকা খাতুন। তার বাবা ছিল একজন সরকারি কর্মকর্তা। সালামতউল্লাহ জীবনে দুটি বিয়ে করেন। শহীদ সাবের ছিল ১ম ঘরের সন্তান। এ ঘরে ২ টি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। শহীদ সাবের ও সাইফুল্লাহ। শহীদ সাবের ছিল সাইফুল্লার ৫ বছরের বড়। সাইফুল্লাহ পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। তার বাবা ২য় বিয়ে করেন নুরন-নাহার নামে এক কন্যাকে। তার ঘরে জন্ম নেয় আরও সাত সন্তান। শহীদ সাবের ও শফিকা খাতুন ঈদগাও এ থাকতেন শহীদ সাবের ও সাইফুল্লাহকে নিয়ে। আর শহীদ সাবের বাবা ২য় স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন কলকাতায়।

শিক্ষা জীবনঃ
শহীদ সাবেরের নানা বাড়ির সবাই ছিল শিক্ষিত। পড়ালেখার জন্য সবাই তাকে যত্ন নিতেন। তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয় তার মায়ের কাছে। তার পর তাকে ঈদগাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। এখানে তিনি ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। প্রতি ক্লাসে তিনি সাফ্ল্যার স্বাক্ষর রাখেন। তাই তার মা তাকে ভাল স্কুলে ভর্তির চিন্তা করে। তাই তিনি তার বাবার কাছে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। শুরু হল নতুন সংগ্রাম। তার বাবা তাকে ভর্তি করেন কলকাতার নামকরা হেয়ার স্কুলে। সৎ মায়ের কাছে অনেক প্রতিকূলতার মাঝে তাকে পড়তে হত। জামা কাপড় থাকত ময়লা যুক্ত। চেহারায় থাকত অম্লিন ছাপ। মা থাতেও মায়ের অভাব। তবুও তিনি এই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেন। হেয়ার স্কুলে তিনি ২য় স্থান অর্জন করেন। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শিশু সংগঠনের সাথে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে শহীদ সাবেরের বাবা সকলকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। শহীদ সাবের ভর্তি হলেন চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪৯ সালে চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হয় চট্রগ্রাম সরকারি কলেজে। ভর্তির পর তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ছাত্র ফেডারেশনের সভায় বক্তব্য দেয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করেন। ফলে এই সময় তার পড়ালেখার চরম ব্যঘাত হয়। ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলা থেকে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে দেশের সরকার পরিবর্তন হলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর তিনি ভর্তি হয় জগ্ননাথ কলেজে বিএ ক্লাসে। ১৯৫৫ সালে তিনি জগ্ননাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এর পর তিনি আর পড়ালেখা করেনি।

রাজনৈতিক ও সাংবাদিক জীবনঃ
শহীদ সাবের স্কুলে পড়ার সময় ছোট দের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। হেয়ার স্কুলে থাকা অবস্থায় জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শিশু সংগঠনের সাথে। এসময় ছোটদের আসরের লাইব্রেরী ছিল। তিনি এখানে ছোটদের জিবনি,রাজনিতীর বই পড়তেন। ঐ সময় তিনি ‘ ছন্দশিখা’’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন। এবং তিনি এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ছন্দশিখার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
দেশ বিভাগের পর তিন ভর্তি হলেন চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে তখন তিনি মুকুল ফৌজ নামে একটি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।১৯৪৯ সালে তিনি ভর্তি হয় চট্রগ্রাম সরকারি কলেজে। ভর্তির পর তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর কর্মী হয়। তখন কমিউনিস্ট পার্টি যারা করতেন তাদের বিরুধে সরকার কঠিন ভূমিকা পালন করতেন। কোন মিছিল মিটিং সভা করলে তাদের গ্রেফতার করা হত। ১৯৫০ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ছাত্র ফেডারেশনের সভায় বক্তব্য দেয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করেন। ১ম তাকে রাখা হয় চট্টগ্রাম জেলে। পরে রজশাহী জেলে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি জগ্ননাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর তিনি দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। এখানে তিনি সম্পাদকিয় ও সাহিত্যিক পাতায় লিখতেন। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে চাকরি করেন।

পারিবারিক জীবনঃ
শহীদ সাবের ছাত্র জীবনে ছিল পড়ালেখা ,রাজনৈতিক নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তার উপর বিনা কারনে ৪ বছর জেল। জেল থেকে বের হয়ে কর্ম ব্যস্ততার কারনে বিয়ের কথা তিনি চিন্তা করতে পারেনি। এছাড়া তিনি বাবা মা উভয় এর কাছে তিনি ছিল অবহেলিত। রাজনীতি করে বলে তার বাবা তাকে পছন্দ করতেন না। চাপের ফলে বি,এ পাশ করার পরই তিনি কর্মে ব্যস্ত। কর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য এসব নিয়ে তিনি মানসিক চাপে থাকতেন। এছাড়া মামার বাড়িতে থাকা অবস্থায় তিনি এক মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। পরে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। এরফলেই মনে হয় বিয়ের প্রতি তার অনীহা হয়ে পড়েন। ১৯৫৮ সালের পর তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।

চাকরি জীবনঃ
শহীদ সাবের ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর তিনি রাজধানী পুরান ঢাকায় ওয়েস্ট এ্যান্ড হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি বেশী দিন চাকরি করেনি। চাকরি ছেড়ে তিনি দৈনিক পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি এখানে চাকরি করেন। এখানে চাক্রী করা অবস্থায় তিনি পাকিস্তান সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তার চোখের সমস্যার কারনে পরীক্ষা দেয়নি। এরপর তিনি ফেডারেল ইনফর মেশিন সার্ভিসে পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষায় তিনি সবচেয়ে বেশী মার্কস পান। কিন্তু দুঃখ সাবেরের পিছু ছাড়েনা। একটার পর একটা লেগেই থাকত। তার উপর বিনা কারনে ৪ বছর জেলে থাকতে হয়। এর জন্য তাকে তৎকালীন সরকার তাকে চাকরির জন্য অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। এরপর তিনি শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি যান তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের কাছে। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান তাকে আশ্বাস দেন চাকরী দেয়ার জন্য। কিন্তু এখানে বটে সাধল সামরিক শাসন। ১৯৫৮ সালে ৮ অক্টোবর তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা প্রধান আয়ুব খান দেশের সামরিক শাসন জারি করেন। ফলে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ক্ষমতা চুত্য হন। পূর্ব বাংলার গণতন্ত্রের পতনের সাথে শহীদ সাবেরের ও স্বপ্নের পতন হয়।

সাহিত্যিক জীবনঃ
শহীদ সাবের ছোট কাল থেকেই সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। কলকাতার হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিজের হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন। এখানে তিনি নিজে নিয়মিত লেখতেন। শহীদ সাবেরের প্রথম লেখা প্রকাশ হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। এ সময় তিনি হেয়ার স্কুলে অধ্যায়নরত। ১৯৫১ সালে তিনি কারাগারে বন্দি অবস্তায় লিখেন তার বিখ্যাত রচনা ‘ আরেক দুনিয়া থেকে’’ । এটি ছিল তার তার বন্দি জীবনের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা। এই লেখাটি সে সময় জেল ফাকি দিয়ে চলে যায় কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায়। এই গ্রন্থটি প্রকাশ হয় জামিল হোসেন নামে। সে সময় তার এ রচনাটি ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ১৯৪৭ সালে চট্রগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় তিনি ‘ আবেগ’’ নামে একটি গল্পে সীমান্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘ এক টুকরো মেঘ’’ নামে একটি গল্প। এছাড়াও বিষকন্যা,জাসু ভাবীর জন্য, দেয়াল, এক টুকরো মেঘ, ছেলেটা, শেষ সংবাদ, প্রানের চেয়ে প্রিয়, যে গল্প কেউ বলে নি। যৌবন, ও চালচুলো, নামে ১০ টি গল্প নিয়ে রচিত হয় ‘’ এক টুকরো মেঘ’’ ১৯৫৭ সালে তার জেল জীবনে নতুন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘’ রোজনামচা’’ গ্রন্থটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ করেন ছোটদের জন্য গল্প গ্রন্থ ‘’ ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান। তিনি একই বছর ‘’ পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগোলের পাগলে ডাইরী ও ক্যাথরিন অয়েন্স পিয়ারের কালো মেয়ের স্বপ্ন, নামে তিনটি অনুবাদ গ্রন্থ রচনা করেন।
প্রকৃতপক্ষে শহীদ সাবেরের সাহিত্য জীবন ছিল মাত্র ৪ বছর। ১৯৫৮ সালে তিনি মানসিক ভারসাম্যহিন হয়ে পড়েন। ফলে তিনি আর কোন গ্রন্থ রচনা করতে পারেনি। তার পরও তিনি কিছু কবিতা লিখেছিলেন যার কোন খবর পাওয়া যায়নি।

ভারসাম্যহীন শহীদ সাবেরঃ
শহীদ সাবের সারা জীবনই মানসিক চাপে ছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তাকে তার মা কলকাতায় পাটিয়ে দেন তার সৎ মায়ের কাছে। সৎ মা তাকে অন্য চোখে দেখতেন। সৎ মায়ে আচারনে তিনি মানসিক ভাবে অনেক কষ্ট পান। মা থাকতে ও মায়ের আদর স্নেহ থেকে তিনি বঞ্চিত হন। ১৯৫০ সালে জেলে নেয়ার পর তার মা তাকে মুক্তির জন্য অনেক ব্যবস্থা করেন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এতে তিনি রাজি না হওয়ায় বাবার কাছ থেকেও তিনি স্নেহ বঞ্চিত হয়। জেল থেক বের হওয়ার পর তার বাবা তাকে চাকরির জন্য চাপ তাকে সংসারের অভাবের কথা তাকে বলা হত এতে তিনি আরও মানসিক চাপে পড়েন। এছাড়াও তিনি প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার ফলে তিনি নিজেকে অনেক ছোট ভাবতেন। মানসিক ভাবে তিনি আরও ভেঙ্গে পড়েন। সম্ভবত অত্যন্ত মানসিক চাপের কারনে ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে মানসিক পরিবর্তন আসতে থাকে। ১৯৫৯ সালের প্রথম দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। এরপর থেকে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। এ সময় তার পড়নে ছিন্ন ভিন্ন কাপড় থাকত। এ সময় তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। সারাদিন ঘুরে ফিরে রাত্রে ফিরতেন সংবাদ অফিসে। এখানে কখনো ফ্লোরে কখনও চেয়ারে আবার কখনও বারান্দায় ঘুমাতেন। কচিকাঁচার মেলার পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দোদা ভাই এর চেষ্টায় সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ্য থেকে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তিনি কিছুটা সুস্থ হলেও চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে তিনি আগের অবস্থায় ফিরে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্তাতেই ছিলেন।

সন্মাননা ও স্বীকৃতিঃ
শহীদ সাবের জীবিত অবস্থায় কোন সন্মাননা পায়নি। তবে তার মৃত্যুর পর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী তার সাহিত্য সরূপ ( মরণোত্তর ) সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেন।

মৃত্যুঃ
১৯৭১ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর পাকিস্তানের দো’স’র’রা সংবাদ অফিস জ্বালিয়ে দেন। শহীদ সাবের ঐ সময় সংবাদ অফিসে ঘুমাচ্ছিল। সংবাদ অফিস পু’ড়ে ছাই হয়ে যায় সে সাথে শহীদ সাবের ও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শহীদ সাবেরের নাম তো দূরের কথা তার কোন হাড় গোড় ও খোঁজে পাওয়া যায়নি।

মনির উদ্দীন ইউসুফ

প্রাথমিক পরিচয়ঃ বহু ভাষাবিদ , প্রাবন্ধিক, কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার,অনুবাদক,চলচ্চিত্রকার, গল্পকার, সাংবাদিক, এত সবগুণের অধিকারী ব্যক্তির নাম মনির উদ্দীন ইউসুফ। তাঁর লেখার মূল প্রেরণা ছিল ধর্মী জীবন ধারা, মুসলিম ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। তিনি ছিলেন ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে পণ্ডিত । তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সফল অনুবাদক এবং আত্নজীবনী লেখক। 

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মনির উদ্দীন ইউসুফ ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারীর তড়াইল থানার জাওয়ান গ্রামের বিখ্যাত “ জাওয়ান সাহেবের বাড়িতে”। তাঁর নানা ছিলেন জাওয়ানের জমিদার আবদুল হাকিম খান চৌধুরী। সুলতান আমলের “ ইকলিম ই মুয়াজ্জামা-বাদ” নামক প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল এখানে । নূর খান ইবনে রাহাত খান মোয়াজ্জেম ছিলেন জাওয়ান বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । মনির উদ্দীন ইউসুফের পৈতৃক নিবাস ছিল কিশোরগঞ্জের সদর থানার অন্তর্গত বৌলাই গ্রামের বৌলাই সাহেবের জমিদার । তাঁর বাবা ছিলেন জমিদার আল্লামা মিসবাহ উদ্দীন আহমদ এবং মাতার নাম সানজিদা খাতুন। বোলাইয়ে তার পরিবার এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবার হিসেবে খ্যাত। সম্রাট জাহাঙ্গীর আমলে বাগদাদ থেকে দিল্লিতে আশা মোগল মীর বহর আশায়ক আব্দুল করিম ছিলেন এ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ভাটি অঞ্চলের নৌ-বাহিনীর কর্তৃত্ব ভার দিয়ে তাকে এ অঞ্চলে পাঠানো হয় । সম্রাট আকবরের সাথে ঈসা খাঁর যে সন্ধি চুক্তি হয় , তারই ধারাবাহিকতায় করিম খাঁর এই নিযুক্তি। ফলে দেখা যায় একটি বনেদি পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হয় মনির উদ্দীন ইউসুফের। তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য কবিসাহিত্যিক আর রাজনীতিবিদ । তাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন মাওলানা আবদুল হাই , মাহমুদুর রবি খালেদ, দিলগির আঁকবরা বাদি, যোশ মালিহা, মহিউদ্দীন মাহমুদ, সৈয়দ হাবিবুল হক ,প্রমুখ।

শিক্ষা জীবনঃ বহুল প্রজ মনির উদ্দীন ইউসুফের শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার বাবার কাছ থেকে । তার বাবা ছিলেন প্রখ্যাত আলেম । সেই সূত্রে বাবার কাছ থেকে আরবি শিক্ষার প্রাথমিক ঙ্গান নেন। এভাবে তিনি শিশুকালেই বহু হাদিস এবং ইসলামিক ইতিহাস ও আত্নজীবনী মুখস্থ করেন। তার বাবার সখ ছিল ছেলেকে আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত করা। কিন্তু মনির উদ্দীন ইউসুফ পরিষ্কার জানিয়েদেন তিনি আরবী লাইনে পড়াশোনা করবেন না। ইউসুফের পক্ষ হয়ে তার নানা তার বাবাকে জানিয়েদেন ,ইউসুফ জাওয়ানেই পড়াশুনা করবে। নানার ইচ্ছানুযায়ী ভর্তি হন জাওয়ান আদর্শ ইংরেজী মধ্য স্কুলে । জাওয়ান মধ্য ইংরেজী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে। এই সময় তার সহপাঠী ছিলেন সৈয়দ নুরুদ্দীন।এখানে দুই বছর পড়াশুনা করে চলে যান ময়মনসিংহে । সেখানে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। এখানে এসে তিনি পড়াশুনায় অনেক বেশি মনযোগি হন । ফল শ্রুতিতে ১৯৩৮সালে লেটার সহ  প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন। এরপর তার বাবা তাকে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লার পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজে ভর্তি করেদেন। ১৯৪০ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে আইএ পাশ করেন । ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থিরতার তাড়না জমিদার পরিবারের সদস্য হিসেবে তাকে প্রভাবিত করে। তাই শিক্ষা জীবনকে ইস্তফা দিয়ে চলে যান গ্রামের বাড়িতে । বাবার শত অনুরোধও মনির উদ্দীন ইউসুফকে পড়াশুনায় ফিরাতে পারেনি। এখানেই তিনি তার শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন। 

পারিবারিক জীবনঃ সব্যসাচী মনির উদ্দীন ইউসুফ বাবার মৃত্যুর পর ১৯৪৪ সালে চাচাত বোন সাজেদা খাতুনকে বিয়ে করেন। সুনামগঞ্জের সেল বয়সের জমিদারে দেখাশুনা করার জন্য স্বসস্ত্রীক সেখানে গমন করেন । ১৯৪৯ সালে মায়ের পরামর্শে তিনি আবার ফিরে আসেন । ১৯৫১ সালে তিনি সপরিবারে চলে যান ময়মনসিং হ শহরে । ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর মনির উদ্দীন ইউসুফ নতুন জীবন গঠনের পত্যয় নিয়ে চলে যান ঢাকায় । বাসা নেন লালমাটিয়ায় । এভাবে সপরিবারে ভাসতে ভাসতে সর্বশেষ পুরান ঢাকার আলী নকীর দেউড়ীতে এসে স্থায়ী হন। 

কর্ম জীবনঃ মনির উদ্দীন ইউসুফের কর্ম জীবনের শুরু হয় দিল্লীতে। নতুন দিল্লীর জেনারেল হেডকোয়ার্টারে কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েট চাকুরী নেন। চাকুরির সূত্রে তাকে বোম্বাই পাঠানো হয় । কিন্তু বাবার অসুস্থতার জন্য দেশে চলে আসলে আর ফিরে যান নি। বাবার মৃত্যুর পর তিনি বাবার জমিদারি দেখাশুনা করতে থাকেন । এর মায়ের আদেশ আর মামা আবদুল মোকাব্বির খানের নির্দেশে জওয়ান স্কুলে হেড মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জমিদারী উচ্ছেদের পর ১৯৫৪ সালে ময়মনসিং হে কন্ট্রাক্টরির ব্যবসা নেন । কিন্তু ব্যবসায়ের আগা গোড়া কিছুই জানা না থাকায় লোকসানের সম্মুখীন হন । চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে তিনি ঢাকায় এসে ইংরেজী দৈনিক অবজারভারে এবং পরে দৈনিক বাংলায় চাকুরি নেন। এরপর নিয়োজিত হয় ও সমানিয়া বুক ডিপুর স্বত্বাধিকারী নূরুল ইসলামের পূর্বালী পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে। এরপর তিনি ছেলেবেলার বন্ধু সৈয়দ নুরুদ্দিনের আমন্ত্রণে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে যোগদান করেন। কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগে মাসিক “কৃষি সমাচার” নামক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন । তিনি ছিলেন এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠানিক সম্পাদক। এই দায়িত্বে কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি ১৯৭৯সালে অবসর নেন । 

সাহিত্যিক জীবনঃ মনির উদ্দীন ইউসুফের সাহিত্যিক জীবনের শুরু তার বাবার মাধ্যমে । ছেলেবেলা বাবা থাকে ইসলামের বিভিন্ন কাহিনী বিশেষ করে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবনী বলতেন। তখন থেকেই তার জীবনে সাহিত্য বাসা বাঁধে । সপ্তম শ্রেণী থেকে তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। ময়মনসিং হে থাকা কালে সুসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদের সাথে তার পরিচয় তার সাহিত্য চর্চাকে আরো বেশি প্রভাবিত করে । তার শিক্ষাবাদের মধ্যে ছিলেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আব্দুল ওয়াদুদ , মোহিতলাল মজুমদার , ডঃ আশুতোষ ভত্তাচার্য,কবি জসীম উদ্দীন প্রমুখ। তার হাউজ টিউটর ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। এতসব ঙ্গানী গুনীর ছায়ায় তিনি হয়ে ওঠেন একজন স্মরণীয় বরনীয় লেখক। ফলে লেখা-লিখির নেশা তাকে দারুনভাবে পেয়ে বসে । ১৯৪১ সালে তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ “উদায়ন” প্রকাশিত হয় । প্রথম গ্রন্থটি তিনি শিক্ষাগুরু কাজী ওয়াদুদের নামে উৎসর্গ করেন। এরপর রচনা করেন উর্দু বাংলা রচনা করেন। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার কারনে বইটির স্বত্ব বিক্রি করার কারনে বইটিতে তার নাম ছাপা হয়নি। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ “ইকবালের কাব্য সঞ্চালন” । ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস “ঝড়ের রাতের শেষে” । ১৯৬৩ সালে জন ম্যারিয়ান গাউস রচিত “Refection of public Administration”নামক বইয়ের তর্জমা “জনপ্রশাসনের বিভিন্ন দিক” এবং উর্দু কবি আসাদুল্লাহ খান গালিব এর “দিওয়ানই গালিব” এর অনুবাদ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়। ও সমানিয়া বুক ডিপো প্রকাশ করে তার জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ হযরত ফাতেমা (রাঃ) (১৯৬৩), অনুবাদ গ্রন্থ “ রুমীর মাসনবী (১৯৬৬), হযরত আয়েশা (রাঃ) (১৯৬৮) ।             

সৈয়দ নিজামুদ্দিন বিরচিত উর্দু ফার্সি কবিতার অনুবাদ “কালমে রাগিব” প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে । তার রচিত “উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস” নামক বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে । তার রচিত “ঈসা খাঁ” নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে । তার রচিত অন্যান্য কবিতা গ্রন্থগুলো হল ঃ রাত্রি নয় কলাপী ময়ূর নয় (১৯৭৬), বেতন পাতা জলের ধারা (১৯৮৪), এক ঝাঁক পায়রা (১৯৮৮), মনির উদ্দীন ইউসুফের অগ্রস্থিত কবিতা-আব্দুল হাই সিকদার সম্পাদিত (১৯৯০), কাব্য সমগ্র বেলাল চৌধুরী  সম্পাদিত (২০০৮) । মনির উদ্দীন ইউসুফের সতের বছরের গবেষণার ফসল বিখ্যাত কবি ফেরদৌসী রচিত “শাহনামার” অনুবাদ গ্রস্থ যার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৭৭সালে ,১৯৭৯সালে দ্বিতীয়টি এবং ১৯৯১ সালে ৬ খন্ডে রয়েল সাইজে একসেট সমগ্র শাহনামার তর্জমা প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমী কর্তৃক । তার রচিত অন্যান্য অনুবাদ গুলো হলো গালিবের কবিতা (২০০২) , হাফেজের গজল (২০০৮) । তার রচিত ইসলাম ও মুহাম্মদ (সঃ) (২০০৮),তার রচিত আত্নজীবনী গ্রন্থ “আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা (১৯৯২) । তার রচিত অন্যান্য উপন্যাস গুলো হলো পনসের কাটা (১৯৮১) , ওর বয়েস যখন এগারো (১৯৮১), উপন্যাস সমগ্র আব্দুল হাই সিকদার সম্পাদিত (২০০৩) । মনির উদ্দীন ইউসুফ রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলো হলো আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতি (১৯৭৮,১৯৮৩,১৯৯৩), কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত (১৯৭৯,১৯৯১) , বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব (১৯৬৯,২০০১) , উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৬৮) , সংস্কৃতি চর্চা (১৯৮০), বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষে একটি প্রস্তাব (১৯৮৪) , নব মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৯), আত্ন পরিচয় ঐতিহ্যের আলোকে (২০০৩), তার শিশুতোষ গ্রন্থ হলোঃ ছোটদের ইসলাম পরিচয় (১৯৮৬,১৯৯০,১৯৯৩,২০০২), ছোটদের রাসূল চরিত (১৯৯৩,২০০১), চলো যায় ছড়ার দেশে (২০০৩), প্রকাশিত গ্রন্থ চিঠি (বাবির কাছে লেখা ও বাবির ব্যক্তিগত পত্রাবলি ) , মনীষা (বিভিন্ন মনীষীর উপর লেখা প্রবন্ধ অসমাপ্ত কবিতা ও প্রবন্ধ, Iranian influence the Aesthetic Aspects of out life, Karbala is a social whirlpool (প্রবন্ধ), নবমূল্যায়ন ইকবাল (অসমাপ্ত প্রবন্ধ) বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে একটি রাজনৈতিক সামাজিক ইশতেহার । 

চলচ্চিত্র জীবনঃ বহুগুণের অধিকারী মনির উদ্দীন ইউসুফ চলচ্চিত্র অঙ্গনে ও পদার্পন করেছেন । ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি চলচ্চিত্র নির্মানে মনোনিবেশন করেন । তার চলচ্চিত্র গুলো হলো ঃ আলোমতি (১৯৬৯ সংলাপ রচনা) তানসেন (১৯৭০, আংশিক চিত্রনাট্য) , তীর ভাঙ্গা ঢেউ (১৯৭৫ , কাহিনী ,সংলাপ ও গীতি রচনা) ।এ লাইনে তার প্রচুর টাকা পয়সা খরচ হলেও আশানুরোপ ফলপাচ্ছিলেন না । তাই চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে করে নেন । 

পুরস্কারঃ বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা এবং বিদেশী গ্রন্থকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার মাধ্যমে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মনির উদ্দীন ইউসুফ। অসংখ্য পুরস্কারে ভুষিত হন প্রতিভাবান সাহিত্যিক মনির উদ্দীন ইউসুফ । সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৮ খ্রীষ্টাব্দে গভর্ণরের স্বর্ণপদ পান। তার অন্যান্য পুরস্কার গুলো হলো বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৮), আবুল মনসুর আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫) , মরণোত্তর একুশে পদক(১৯৯৯)। 

মৃতুঃ বাংলা সাহিত্যতে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য প্রখ্যাত কবি , সাহিত্যিক ও গবেষক মনির উদ্দীন ইউসুফ নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। বাঙ্গালী পাঠকের জন্য উর্দু – ফার্সি শাস্ত্র পাঠে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন । বহু ভাষাবিধ মনির উদ্দীন ইউসুফ । জমিদার পরিবারে বড় হয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তিনি যে গবেষনা করেছেন তা তা বাংলা সাহিত্যে বিরল ।এই ক্ষনজন্মা পুরুষ ১৯৮৭সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ৬৮ বছর বয়সে ঢাকার শহীদ সোহারাওয়ার্দী হাসপাতালের পরলোকগমন করেন। কিশোরগঞ্জের বৌলাই তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। 

========০০০০০০========

Exit mobile version