দুপুরের তীব্র রোদে উত্তপ্ত চারদিক। গরম থেকে বাঁচতে কেউ কেউ গায়ের কাপড় হাতে নিয়ে চলছে। সবুরের হাতে জামা ও স্যান্ডেল। সূর্যের চোখ রাঙানির কারণে সে মাথা নিচু করে হাঁটছে। অন্যদিকে মনোযোগ নেই তার। হঠাৎ কে যেন বলল, ‘পেরুন আর স্যান্ডেল হাতে নিয়া কই যাও সবুর?’ আচমকা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে সবুর কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু ওপরের দিকে চোখ তুলতেই তার বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। মেয়েটি তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন উত্তর না পাওয়ায় সে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন। সবুর বিস্ময় কাটিয়ে বলল, ‘আমাগো ফয়েজের বিয়া, তাই বরযাত্রী যাইতাছি।’
‘তয় এইগুলা হাতে নিয়া যাও ক্যান?’ এই বলে কাজলী সবুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

কাজলীর বুকে উথাল-পাতাল খেলছে। চোখ দুটি আলগা হয়ে গেল। কয়েক ফোঁটা জল মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সেদিকে খেয়াল না করে সবুর পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলো। কাজলী দৌড়ে সবুরকে থামিয়ে বলল, ‘না হয় তোমার ঘরনি হই নাই, তাই বইলা কি আমি ফয়েজের বিয়ায় দাওয়াত পাইতে পারি না?’
‘আমারই দাওয়াতের ঠিক নাই, তয় তোমারে ক্যামনে দাওয়াত দিমু? তুমিই কও কাজলী, গরিব মাইনসের কি কোনো দাম আছে?’ এই বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সবুর। তাতে কাজলীর বুকের মাঝের হাহাকার আরও বেড়ে গেল। আঁচল থেকে কয়টা টাকা বের করে সবুরের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে যাও, তয় এই টাহাগুলা দিয়া একটা পেরুন আর স্যান্ডেল কিন্না নিও।’ সবুর টাকা নিতে চাইল না কিন্তু কাজলী জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলো। সবুর এবার সিক্ত চোখে কাজলীর চোখের দিকে তাকাল।

দুই সন্তানের জননী হলেও কাজলীর চেহারা আগের মতোই আছে। সেই টানা টানা চোখ, মায়াবী মুখ, গোলাপের পাপড়ির মতো রাঙা ঠোঁট! অথচ সবুরের চোখ-মুখ গর্তে ঢুকে গেছে। সবুর হারিয়ে গেল পুরনো দিনে। মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখে আবছা দেখছে সে। মনে হচ্ছে যেন তার সামনে সেই তেরো-চৌদ্দ বছরের টগবগে কাজলীই দাঁড়িয়ে আছে। তাই সে সাথে সাথে কাজলীকে জড়িয়ে ধরতে গেল। কিন্তু কাজলী নিজেকে একটু পেছনে সরিয়ে নিলো। আর তাতে সবুর মাটিতে পড়ে গেল। কাজলী সবুরের দু হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, ‘শিগগির হাঁটা দাও সবুর’। সবুর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া জামা ও স্যান্ডেল উঠিয়ে জামাটি ঝাড়তে ঝাড়তে জোর পায়ে হাঁটতে লাগল। আর কাজলী সেই দৃশ্য দেখে আঁচল দিয়ে ভেজা চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরল।

সবুররা পাঁচ ভাই। তাদের মধ্যে সে তৃতীয় কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে সবার নিচে। তাই সে একসময় খুব আফসোস করে বলত, ‘আমারে ক্যান করিম চৌধুরীর ঘরে জন্ম দিলো না আল্লায়? তাইলে তো আর না খাইয়া থাকতে হইতো না।’ করিম চৌধুরীর বাড়ি পাশের গ্রামে। তার অনেক সম্পত্তি। আর ওই সম্পত্তি দেখেই সবুরের এত আক্ষেপ।
আজ তার একেবারে ছোট ভাই ফয়েজের বিয়ে। ভাইয়ের বিয়ে হলেও গায়ে জড়ানোর মতো ভালো কোনো পোশাক তার নেই। একটা জামা আছে কোনো রকম। তাও আবার কয়েক জায়গায় তালি দেওয়া। স্যান্ডেল জোড়া যে সে কতবার মুচির কাছ থেকে ঠিক করিয়ে এনেছে তারও কোনো ঠিক নেই। সে এই জামা ও স্যান্ডেল পরে না বললেই চলে। যদি কোথাও বেড়াতে যেতে হয় তখন পরে। তাও যাওয়ার সময় জামাটি কাঁধে আর স্যান্ডেলটি হাতে নিয়ে যায়। যখন গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন গায়ে জড়ায়। এরপর সেখান থেকে ফেরার সময় তা খুলে আবার হাতে নেয়। এই হলো তার অবস্থা। আজ আপন ভাইয়ের বিয়েতেও সে একই কাজ করছে।
‘ওহই ওহই পালকি বউ নিয়া আইছি’Ñ এই বলে চার বেহারা পালকিটি ঝুলাচ্ছে আর প্রত্যেক ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। এর অর্থ হলো ‘ভালো মাসাত’ দিতে হবে। ফয়েজ তার নোয়াভাই গফুর অর্থাৎ চতুর্থ ভাইয়ের সাথে থাকে। একসময় পাঁচ ভাই একসাথে থাকলেও বিয়ে করে বড় তিন ভাই আলাদা হয়ে যায়। ওই তিন ভাইয়ের ঘর থেকে টাকা উঠিয়ে পালকিওয়ালারা গফুরের ঘরের সামনে পালকি রাখল।

বড় ভাই হিসেবে অন্য তিন ভাইয়ের দায়িত্ব থাকলেও যেহেতু ফয়েজ গফুরের সাথে খায় তাই মূল দায়িত্বটা মূলত গফুরের স্ত্রী কল্পনারই। কিন্তু কল্পনার কেন যেন আজ মন ভালো নেই। কেন ভালো নেই তা এই বাড়ির কারও অজানা নয়। তবে কল্পনা কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে নতুন বউকে বরণ করার জন্য যা যা করার সবই করছে। পালকি থেকে নতুন বউকে নামাতে নামাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হারিকেনের আলোতে বউয়ের চেহারা ততটা বোঝা যাচ্ছে না।

নতুন বউয়ের নাম আমেনা। তাকে একটি পাটার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সামনে একটি কুলা। তার মধ্যে কিছু দূর্বা ঘাস, কয়টা ধান, সরিষা, কাঁচা হলুদসহ অনেক জিনিস। গ্রামের বধূরা শুরু করল বিয়ের গীত। এদিকে একটি হুলুস্থূল কাণ্ডও ঘটে গেল। বউয়ের ধৈর্য পরীক্ষার জন্য সবাই তাকে চিমটি দিতে লাগল। চারদিকে থেকে সবাই এতই অত্যাচার করতে লাগল যে আমেনা কখনো এদিক ঘোরে আবার কখনো ওদিক ঘোরে। কিন্তু যেদিকই ঘুরুক না কেন, কোনো দিক থেকেই রক্ষা নেই। এমনকি তার স্তনে হাত দিতেও কার্পণ্য করেনি আশেপাশের দুষ্টু ছেলেরা।

নতুন বউ, তাই শরীরের ওপর দিয়ে যত কিছুই যাক না কেন, মুখ ফোটে কিছু বলা যাবে না। এরকম অবস্থা দেখে বাড়ির মুরব্বিরা এসে রাগারাগি করে সবাইকে দূরে সরিয়ে দেন। এরপর বাড়ির বউ-ঝিরা কুলার মধ্যে থাকা সবকিছু আমেনার পুরো শরীরে ছিটিয়ে দিয়ে গীত গাইতে গাইতে ঘরের মধ্যে নিয়ে যায়।

রাত একটা। বাসরঘরে নীরবে বসে আছে আমেনা। ফয়েজ এসে তার পাশে বসল। আমেনার শরীর কাঁপছে। কিন্তু কেন কাঁপছে সে নিজেও জানে না। তাছাড়া ধৈর্যের পরীক্ষায় সে পাস করলেও দুষ্টুদের নখের আঁচড়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছিলে গিয়ে জ্বলছে। স্ত্রীর ওপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা ফয়েজও দেখেছে। কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। এটা যে এই অঞ্চলের রীতি। রীতি যখন প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যায় তখন কার সাধ্য আছে তা ভাঙার? ফয়েজের বেলাতেও তাই হয়েছে।
অবশেষে ফয়েজ আমেনার কাঁধে হাত রাখল। এই প্রথম কোনো পুরুষের হাত তার কাঁধ ছুঁল। শরীরে যেন ইলেকট্রিকের শক লাগল। পুরো শরীর নেচে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বউয়ের চোখে জল দেখে ফয়েজের বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। ‘তাহলে কি আমেনা বিয়াতে রাজি ছিল না?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিলো আমেনাই। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘বউ মরলে তাতে আর কী আসে যায়? পুরুষমানুষ আবার নতুন কাউরে পাইবে।’ আমেনা যে কথাটা অনেকটা অভিমানেই বলেছে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারল ফয়েজ। তাই সে সাথে সাথেই আমেনাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। স্বামীর স্পর্শে আমেনার মুখে জমে থাকা সকল অভিমান কর্পূরের মতো উবে গেল। স্নিগ্ধ সফেদ মুখটিতে ফোটে উঠল এক চিলতে হাসি। কিন্তু নিমেষেই তা বিলীন করে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শরীলে অনেক ব্যতা, হাত দিও না।’

‘কোতায় ব্যতা দেহি তো’। এই বলে ফয়েজ আমেনার শরীরের আচ্ছাদন খুলে দিতেই আমেনা বলল, ‘আমার বুঝি শরম করে না?’ ‘শরম’ এই বলে ফয়েজ আমেনাকে শক্ত হাতে বাহুবন্দি করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমেনা প্রচণ্ড কাশতে লাগল, সাথে ফয়েজও।
বাইরে থেকে প্রচণ্ড হাসি-তামাশার শব্দ কানে আসছে। কিন্তু তারা কেন এমন করছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না আমেনা। এর মধ্যে ফয়েজ বিছানা থেকে উঠে চারদিকে কী যেন খুঁজতে লাগল। আমেনা তড়িঘড়ি করে নিজের কাপড় ঠিক করছে। হঠাৎ ফয়েজ একটি জ্বলন্ত শুকনো মরিচের বাসন হাতে নিয়ে তার সামনে ধরে বলল, ‘পাইছি।’ আমেনা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে কিন্তু তার আগেই পোড়া মরিচের ঝাঁজে সে আরও জোরে জোরে কাশতে লাগল। এরপর ফয়েজ জ্বলতে থাকা মরিচের বাসনটির মধ্যে এক মগ পানি ঢেলে সেটিকে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। আর এ সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলো খলখল করে হাসতে লাগল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমেনা গোসল সেরে রান্নাঘরে গেলে গফুরের স্ত্রী কল্পনার বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। এই প্রথম সে আমেনাকে ভালোভাবে দেখল। আমেনার চেহারা যে এত সুন্দর তা সে কল্পনাই করতে পারেনি। কল্পনা আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন ভেবে স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘বহো বউ।’ কিন্তু কম্পমান ঠোঁটে কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। তারপরেও আমেনা বুঝতে পারল কী বলেছে সে।

আমেনা পিঁড়িতে বসে ভাত রান্না করছে। বিয়েবাড়ি, তাই আগে থেকেই বাঁশ ও গাছের ডাল কেটে শুকিয়ে লাকড়ি বানানো হয়েছে। ফলে আগুনে খুব ঝাঁজ। কিন্তু কল্পনার কী হলো? তার বুকের মধ্যে পুড়ছে কেন? কিছু না বলেই সে আমেনাকে রেখে বের হয়ে গেল। ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে বিমর্ষ মুখে আবারও রান্নাঘরে ফিরল।

আগুনের আঁচে আমেনার মুখটি ঘেমে শিশিরের মতো জল জমে গেছে। আঁচল দিয়ে সেই জল মুছতে মুছতে তার চোখ পড়ল কল্পনার চোখের ওপর। ‘চোক মুক ফুলা ক্যান? আর আমারে রাইখা কিছু না বইলা হঠাৎ কই গেছিল?’ মনে মনে কথাটি বলতেই ভাতের পাতিলের পানিতে বলক উঠে ওপরে রাখা ঢাকনাটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সাথে সাথে সে ওড়ুন দিয়ে কয়েকটি ভাত উঠিয়ে টিপে দেখল মাড় গালার সময় হয়ে গেছে। চুলায় গোঁজা লাকড়ি ওপরে উঠিয়ে আমেনা বলল, ‘ভাবি ভাত গড় দিতে হইবো। ওড়ুন নিয়া ডহি সাজান।’

‘এইগুলাও তোমার মায় তোমারে হিগায় নাই!’ এই বলে কল্পনা মালসার ওপর ওড়ুনটি রেখে ভাতের পাতিলটি এনে তার ওপর বসিয়ে দিলো। তবে তার বলা কথাটি আমেনার কানে এখনো ঠনঠন করছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না তার জা কেন এমন করছে। সে মনে মনে বলল, ‘ভাবি নিশ্চয়ই ফয়েজকে বিয়া করাইতে চায় নাই। দুইজনের সম্পত্তি একসাথে আছে। এহন ভাগ হইয়া যাইতে পারে। এই আশঙ্কাতেই হয়তো এমন করতাছে।’ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘরে চলে গেল।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *