‘এত রাইতে কে যায় বাড়ির ওপর দিয়া?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘আর কেডা?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘আর কেডা?’ ‘আমি ওয়াদুদ।’ ‘এই মিয়ারা ফাইজলামি করার আর জায়গা পাও না, তাই না? এই চাঁদনী হারিকেনডা নিয়া আয় তো, কোন বাপের বেডারা যায় মুক কয়ডা একটু দেইখা রাহি।’
জয়নুদ্দিন সর্দারের বয়স এখন আশির কোঠায়। ছেলে হয় না বলে একে একে তিনি আট মেয়ের জনক। চাঁদনী বাদে সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি ধবধবে ফরসা। আর তার স্ত্রী কালো হলেও চেহারার ধরন ছিল অত্যন্ত মনোহারিণী। চাঁদনী তার বাবা-মা উভয়েরই গড়ন পেয়েছে। শরীরের বর্ণ পেয়েছে বাবারটা আর চেহারার ধরন পেয়েছে মায়েরটা। সুতরাং তার ষোলোকলাই পূর্ণ হয়েছে। এত সুন্দর বলে এলাকার সবাই চাঁদের সাথে নাম মিলিয়ে তাকে চাঁদনী নামেই ডাকতে শুরু করে। তাতে একসময় তার নাম হয়ে যায় চাঁদনী। তার বিয়ের জন্য বহু সম্বন্ধ এলেও বিয়ে দেননি জয়নুদ্দিন সর্দার। একে তো সবার ছোট, তার ওপর স্ত্রী মারা গেছেন। মেয়েকে বিয়ে দিলে একেবারেই একা হয়ে যাবেন। অন্য মেয়েরা মাঝে মাঝে এসে দেখে গেলেও এই চাঁদনীকে নিয়েই থাকছেন তিনি।
চাঁদনী হারিকেন নিয়ে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। হারিকেনের আলো চাঁদনীর চেহারায় পড়ে দুধের মতো সাদা চামড়া ঝকঝক করছে। আর সেই দৃশ্য দেখে ওয়াদুদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। চিন্তা করল এই বুড়াকে খ্যাপানো যাবে না। তাই সে জয়নুদ্দিন সর্দারের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে বলল, ‘মাফ করবেন সর্দার সাব।’ এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াদুদকে চিনতে পেরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনি কে?’ পরিচিত ওয়াদুদ উত্তরে বলল, ‘ওয়াদুদ।’ জয়নুদ্দিন সর্দার একটু বিরক্তির স্বরে আবার বললেন,
‘তাইলে তোমার পাশে থাকা আরেকজন কে?’ ‘ইনিও ওয়াদুদ।’ জয়নুদ্দিন সর্দার লাঠিতে ভর করে হাঁটেন। রাগে হাতে থাকা সেই লাঠিটি দিয়ে তার পরিচিত ওয়াদুদকে বাড়ি দিতে গেলেন। এ সময় ক্ষমা চাওয়া ওয়াদুদ সেটা ফেরাতে গেলে তার হাতে বাড়ি লেগে হাত কেটে যায়।
কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি তিনি। ক্ষমা চাওয়া ওয়াদুদকে ঠেলে দিয়ে আবারও বাড়ি দিতে গেলে চাঁদনী এসে ‘এ কী করতাছেন বাবা’ বলে লাঠিটি ধরতে যায়। একই সময়ে ওয়াদুদও লাঠি ফেরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এর আগেই পায়ে লেগে হারিকেনটি উলটে পড়ে নিভে যায়। অন্ধকারে কারও কোনো খেয়াল নেই। ফলে ওয়াদুদের হাতে লাঠি না পড়ে, পড়ে চাঁদনীর হাতে। ওয়াদুদ জয়নুদ্দিন সর্দারকে ভেবে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দয়া কইরা থামেন সর্দার সাব।’ চাঁদনী এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেল। ফলে অনুভূতিতে তার শরীর কেঁপে উঠল। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে ওয়াদুদকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে হারিকেনটি খুঁজতে লাগল।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। চেয়ারম্যান-মেম্বারের লোকেরা ভোট চাইতে জনগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। তিন গ্রামের তিন ওয়াদুদ। একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভাই আর বাকি দুজন তাদের নির্বাচনি কর্মী। তিনজনেরই একই দল ও একই নামের হওয়ায় ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তারা একে অন্যকে ‘মিতা’ বলে ডাকে। যেখানে ভোট চাইতে যায় তিনজনে একই সাথে যায়। এর অবশ্য একটি বড় কারণও আছে। গ্রামাঞ্চলে মানুষ সাধারণত রাতের বেলায় ভোট চাইতে বেশি যায়। যাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকেরা দেখতে না পারে। রাতের বেলায় অন্ধকারে ভোট চাইতে গেলে সবাই জিজ্ঞেস করেÑ কে যায়? এতে তারা তিনবার একই নাম বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আবার কেউ রেগে গেলেও পরিচয় দিলে কিংবা আলোতে গেলে চিনতে পারলে আর কিছুই বলে না। একদিকে ভোট চাওয়া হয়, আবার অন্যদিকে তারা আনন্দও পায়।
চাঁদনী সেদিন ঘরে ফিরে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার কাছে মনে হচ্ছিল ওয়াদুদ তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওয়াদুদের শরীরের গন্ধ তার নাকে আসছে, শরীরের ওম তার শরীরে লেগে আছে। সবকিছু মিলিয়ে চাঁদনীর হৃদয় কুটিরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারবার ঘুমাতে চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না। কারণ ওয়াদুদের প্রেতাত্মা যে তাকে আছর করে রেখেছে। আট বছর আগের কথা মনে করে তার শরীরে সেই অনুভূতি হচ্ছে। যদিও সে এখন ওয়াদুদের ঘরনি কিন্তু তারা যে এখন আর এক বিছানায় ঘুমায় না। চাঁদনীর মন চাচ্ছে সেদিনের মতো ওয়াদুদ এসে তাকে জড়িয়ে ধরুক, হৃদয়ের সকল রাগ-অভিমান ভাঙিয়ে দিক। যদিও এই আট বছরের দাম্পত্য জীবনের হিসেবে সেদিনের কয়েক সেকেন্ডের অনুভূতি কিছুই না। কিন্তু চাঁদনীর কাছে তা এখনো লক্ষ কোটি গুণ বেশি। কারণ ওই দিনের অনুভূতিই ছিল ওয়াদুদের প্রেমে পড়ার মূল কারণ।
আট বছর পেরিয়ে গেলেও চাঁদনীর কোনো সন্তান হচ্ছে না। কিন্তু দোষ কার? স্বামীর, না তার? উত্তরটা কারো জানা না থাকলেও চাঁদনীর ঘাড়েই এসে পড়েছে দোষটা। ওয়াদুদ যদিও মুখ ফোটে কখনো বলেনি, তবে তার পরিবারের এ নিয়ে মাথা ব্যথার কোনো অন্ত নেই। তারা তাকে আবারও বিয়ে করার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ওয়াদুদ কী করে আবার বিয়ে করবে? চাঁদনীকে পাওয়া যে তার কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতোই ছিল। অনেক যুদ্ধ করেই তাকে পেতে হয়েছিল। ভোট চাইতে যাওয়ার দিন অনুভূতি কি শুধু চাঁদনীরই হয়েছিল? মোটেও নয়। ওয়াদুদও সেদিন বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারেনি। চাঁদনীর মতো তারও মনে হতো সে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরে আছে।
সেই পুরনো কথা মনে করে আজ চাঁদনীর চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কাছে সে একজন ‘বাজা’ মেয়ে হিসেবে পরিচিত। মনে হচ্ছে যেন সে এক কলঙ্কিনী। কিন্তু এই কলঙ্ক নিয়ে তার আর দুনিয়াতে বাস করতে মন চায় না। অবশ্য ওয়াদুদও থেমে থাকেনি। ডাক্তার, ফকির, বৈদ্য যে যার কথা বলেছে সেখানে নিয়েই চাঁদনীর চিকিৎসা করিয়েছে। সর্বশেষ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কদম আলী বাবার দরবারে। অনেকে তাকে ‘কদম ফকির’ বলেও ডাকেন। মূলত চাঁদনী এই ফকিরের কাছে যেতে চায় না বলেই ওয়াদুদ বিছানায় মুখ ফিরিয়ে থাকে। কদম আলী বাবা তাকে এক সপ্তাহ তার আস্তানায় রেখে চিকিৎসার কথা বলেন। বাবার বড় বড় চোখের চাহনিতে চাঁদনীর খুব ভয় হয়। কিন্তু ওয়াদুদের অনুরোধে সেখানে থাকতে বাধ্য হয় সে।
এরপরের ঘটনা সবারই জানা। চাঁদনীর চিকিৎসার পরে কদম আলী বাবার নাম হয়ে যায় ‘সন্তান বাবা’। কারণ তার কাছ থেকে আসার পরেই চাঁদনীর গর্ভে সন্তান আসে। দশ মাস দশদিন পরে সে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে। ফলে একদিকে শ্বশুরবাড়িতে চাঁদনীর আদর বেড়ে যায়, অন্যদিকে এই খবর শোনার পরে এলাকার যে মেয়েদের সন্তান হয় না তাদের ভিড় বেড়ে যায়। বাকিদের সন্তান হোক বা না হোক চাঁদনীর সন্তানের কারণে ‘সন্তান বাবা’ বা ‘সন্তান বাবার দরবার’ নামটা বেশ পরিচিতি লাভ করে। কদম আলী বাবা ওরফে সন্তান বাবা প্রতি বছর ওরস বা সিন্নি করেন। ওয়াদুদের সন্তান হওয়ার পর থেকে সে প্রতি বছর সিন্নিতে বড় একটি অঙ্ক প্রদান করে। এ নিয়ে চাঁদনীর বড় ধরনের আপত্তি থাকলেও তা কখনো মাথায় নেয়নি ওয়াদুদ। কিন্তু যার কারণে সে ‘বাজা’ মেয়ে থেকে রত্নগর্ভার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রতি কেন এত বিমুখতা? এই কথাটা কেউ কখনো জানতে চায়নি। কষ্ট তো সবার জীবনেই কম-বেশি থাকে। আবার সুখের আড়ালেও কিছু কষ্ট থাকে। কষ্টের আড়ালের কষ্টের কথা সবাই জানে। তবে সুখের আড়ালে যেই কষ্ট থাকে তা কেউ জানে না বা জানার চেষ্টাও করে না। কারণ বাতির নিচে থাকে অন্ধকার।
চাঁদনী চয়নকে স্তন্য পান করাচ্ছে। হঠাৎ ওয়াদুদ রুমে প্রবেশ করে। সাথে সাথে সে তার স্তনটি কাপড়ের ভেতরে ঢুকিয়ে চয়নকে কোলে নিয়ে বসে রইল। মায়ের দুধ না পেয়ে চয়ন কান্না করতে লাগল। বিষয়টা বুঝতে পেরে ওয়াদুদ আবার বাইরে চলে যায়। যেহেতু প্রথম সন্তান তাই সে মানুষের সামনে স্তন্য পান করাতে এখনো লজ্জা পায়। এমনকি স্বামীর সামনেও।
বিষয়টা হাস্যকর হলেও চাঁদনীর বেলায় এটাই হচ্ছে। তবে নাতির কান্না শুনে শাশুড়ি সুফিয়া বেগম এসে দরজার সামনে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘ও বউ, বাচ্চাডা কান্দে ক্যান?’ এ সময় চয়ন আবারও কান্না করতে লাগল। তিনি বিষয়টা বুঝতে না পেরে কাছে গিয়ে আবার বললেন, ‘খিদা লাগছে মনে হয়, ওরে বুকের দুধ খাওয়াও।’ এরপর চাঁদনী তার সন্তানকে আবারও স্তন্য পান করাতে লাগল। এভাবে আস্তে আস্তে সে লজ্জা ভেঙে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। সন্তান জন্মের পরে চাঁদনী ও তার সন্তানের প্রতি শাশুড়ির আদর বেড়ে গেলেও তা আর বেশিদিন টিকেনি। কারণ এর কিছুদিন যেতেই সুফিয়া বেগম দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন।
এরপর আরও চার বছর কেটে গেলেও চাঁদনী সেই পুরনো কথা ভুলতে পারে না। ভুলবেই-বা কী করে? এইসব কারণেই তো তাকে কদম আলী বাবার দরবারে দ্বারস্থ হতে বাধ্য করেছিল। পাশের বাড়ির এক মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা। ওই সময় এসএসসি পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীরা পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে দোয়া চাইতে যেত। অবশ্য দোয়ার পাশাপাশি কিছু টাকাকড়িও পাওয়া যেত। মুরব্বিরা কয়টা পয়সা হাতে গুঁজে দিয়ে বলতÑ মা কিংবা বাবা কিছু খাইয়ো।
এই যে সামান্য কিছু টাকা তখন যে কতটা তৃপ্তি দিতো তা বলার মতো নয়। তাছাড়া তখন এলাকায় তেমন কোনো রাস্তাঘাট ছিল না। এক মাসের জন্য থানা শহরে থাকতে হতো। হাঁড়ি-পাতিল, চাল, ডাল, তেল, নুন, এমনকি লাকড়িসহ ভ্যান ভাড়া করে নিয়ে যেত। পরীক্ষা কেন্দ্রের আশেপাশের কোনো বাড়ির বারান্দা কিংবা ভাড়া দেওয়ার জন্য বানানো ছোট ছোট টিনের ছাপড়ায় ভাড়া থাকতে হতো। পরীক্ষা দেওয়ার আগে মেয়েটি আশেপাশের সব বাড়ি গিয়ে দোয়া চাইল কিন্তু এলো না চাঁদনীর ঘরে। কারণ চাঁদনী বাজা মেয়ে। তার সামনে দিয়ে গেলে পরীক্ষা খারাপ হবে। বিষয়টা দেখে চাঁদনীর সেদিন মন চেয়েছিল নিজেকে শেষ করে দিতে। সে মেয়েটির জন্য কয়টা পয়সাও আঁচলে বেঁধে রেখেছিল। সেদিন রাতে সে এটা নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে অনেক কান্নাকাটিও করেছিল। তবে তার কাছে দোয়া না চাইলেও মেয়েটির জন্য মন খুলে দোয়া করতে একবিন্দুও কার্পণ্য করেনি সে।
কার্তিক মাস। পানি কমে নদীতে চলে গেছে। খেতের মাটি শুকিয়ে ফেটে ফেটে চাষযোগ্য হয়েছে। লাঙল জোয়াল নিয়ে মাঠে নেমেছে ওয়াদুদ। তার দুটি বলদ আছে। এগুলো দিয়ে সে খেত চাষ করে। এলাকায় ইঞ্জিনচালিত পাওয়ার টিলার কেবল দুই একটা আসা শুরু হয়েছে। তাও যাদের টাকাপয়সা বেশি তাদের। ওয়াদুদের ভরসা অবশ্য এই বলদ দুটিই। রসুন-পিঁয়াজ রোপণের ধুম পড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির মহিলা ও শিশুদেরও দম নেওয়ার সময় নেই। রসুনের প্রতিটি কোয়া আলাদা করে নষ্ট কোয়াগুলো ফেলে দিতে হয়। এরপর কুলা দিয়ে ঝেড়ে তা পরিষ্কার করতে হয়। ভালো কোয়াগুলো রোপণের জন্য খেতে পাঠায়। আবার পিঁয়াজের ক্ষেত্রেও নষ্ট পিঁয়াজ ফেলে ভালো পিঁয়াজগুলো বাছাই করতে হয়। এটা নিয়ে চাঁদনীর আর কাজের শেষ নেই।
দুপুর তিনটা বেজে গেছে। ওয়াদুদ এখনো ভাত খেতে আসেনি। স্বামী ভাত খায়নি বলে চাঁদনীও মুখে ভাত নেয়নি। তাই সে ভাত ও তরকারি গামলায় ভরে প্লেটসহ গামছায় বেঁধে মাঠে চলে যায়। ওয়াদুদ হাল বাইতে বাইতে ঘামে একেবারে নেয়ে গেছে। সেই দৃশ্য দেখে চাঁদনীর বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। খেতের পাশে গামছা দিয়ে বাঁধা ভাত-তরকারি রেখে সে ওয়াদুদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওয়াদুদের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ‘যাহ… যাহ…’ বলে লাঠি দিয়ে বলদ দুটিকে বাড়ি দিচ্ছে আর এগুলো দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ একটি বলদ ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। এ সময় সে বলদটিকে বাড়ি দিয়ে ওঠাতে যেতেই পেছন থেকে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পেল,
‘এই হুনছো? ঐ বোবা জাতরে পিডাইতাছো ক্যান? ওগো বুঝি জিরাইতে হয় না!’ ওয়াদুদ সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে আইলের ওপর গামছা দিয়ে বাঁধা খাবার। সাথে সাথে সে লাঠিটি রেখে দিয়ে চাঁদনীর সামনে এসে দাঁড়াল। চাঁদনীর চোখ দুটি ভেজা। আদিগন্ত প্রচণ্ড রোদ। চোখের ওপর সেই রোদ পড়ে চিকচিক করছে। ওয়াদুদের বুকের মাঝে হু হু করে উঠল। নিশ্চয়ই বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। চাঁদনী ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরতে গেল কিন্তু ওয়াদুদ তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি ঘামে ভিইজ্জা গেছি। তোমার কাপুড় নষ্ট হইয়া যাইব।’ চাঁদনী সেই বাধা উপেক্ষা করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘না হয় আমরা আরেকটু কম খাইলাম, একটু খারাপ কাপুড়-চুপুড় পরলাম; তাই বইলা এত কষ্ট করতে হইবো ক্যান?’
‘এই খেতের মইদ্দে মাইন্সে দ্যাখলে কী কইবো চাঁদনী? যাও, তুমি বাড়ি চইলা যাও। আমি কাম সাইরা বলদ লাঙল নিয়া চইলা আমুনে।’
‘না, তোমারে না নিয়া আমি যামু না।’
‘ঠিক আছে, তয় এহন আমারে ছাইড়া দাও। মাইন্সে দ্যাখলে কইবো ওগো কোনো লজ্জাশরম নাই। দিনদুপুরে ক্যামনে মাইয়া পোলারে জড়াইয়া ধইরা আছে।’
‘কউক, যার যা খুশি কউক। আমরা তো আর পর কেউ না। জামাই বউ-ই তো।’
‘ঠিক আছে, তয় এহন তুমি আইলে বহো। আমি আরেকটু চাষ দিয়া আইতাছি।
‘না, আগে খাইয়া লও। তারপর কাম।’
আইলের মাঝে দূর্বা ঘাসের ওপর গামছা বিছিয়ে ভাত বাড়ল চাঁদনী। এ সময় ওয়াদুদ দেখলÑ একটি নয়, দুটি প্লেট। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘থালা দুইডা ক্যান?’ চাঁদনী মুখে একটু হাসি এনে চাতকের মতো ওয়াদুদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমনিতেই আনছি।’ এবার ওয়াদুদ লক্ষ করল চাঁদনীর চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে। তাই সে সাথে সাথেই বলল, ‘হায় হায়, তুমিও খাও নাই?’ চাঁদনী অবশ্য মুখে কিছু না বললেও মাথা নাড়ল। বিষয়টা দেখে চাঁদনীর প্রতি ওয়াদুদের ভালোবাসা যেন উথলে পড়ল। সে তার থালা থেকে এক লোকমা ভাত চাঁদনীর মুখে তুলে দিয়ে বলল,
‘চাঁদনী, আমি যে তোমার কাছে চিরঋণী হইয়া গেলাম।’ চাঁদনীও নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা ভাত ওয়াদুদের মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই যে তোমার গতরের ঘাম, এই ঘামের ঋণ কি কহনো শোধ করা যায়? হোনো, ভালোবাসার কোনো ঋণ থাকে না, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাইসা যাওয়াই হইছে ভালোবাসার কাজ।’ কথাটা শুনে ওয়াদুদ আর কোনো কথা বলতে পারল না। শুধু সিক্ত চোখে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে রইল।