লাঙল দিয়ে চাষ দেওয়া খেতের ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা বড় বড় চাকার ওপর বসে কতকগুলো পাখি পোকা-মাকড় খাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তারা দ্বীপের মধ্যে জেগে থাকা পাথরের ওপর বসে মাছ শিকার করছে। এ যেন তাদের উৎসব! পেটভরে খাওয়ার উৎসব! পাখিদের এই উৎসবে বাদ সাধল ওয়াদুদ। বড় বড় চাকাগুলো ভাঙতে ও খেত সমান্তরাল করতে বলদ ও মই নিয়ে মাঠে নেমেছে সে। মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বলদ দুটিকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে আর সেগুলো দৌড়াচ্ছে। তবে পাখিগুলোও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। ওয়াদুদ যেদিকে মই দেয় তার উলটো দিকে গিয়ে পোকা-মাকড় শিকার করছে তারা।

ওয়াদুদ এক খেতে রসুন লাগিয়েছে আর এই খেতে লাগাবে পিঁয়াজ। পিঁয়াজ-রসুনের ভালো ফলনের জন্য খেতের চাকা অনেক মিহি করতে হয়। আজ মই দিয়ে সেই কাজটিই করছে সে। তবে থেমে নেই তার স্ত্রী চাঁদনীও। সে বাড়িতে বসে রোপণের জন্য কেনা ছোট পিঁয়াজগুলো বাছাই করে ঝেড়ে প্রস্তুত করছে। তার ছেলে চয়ন কিছুটা বড় হলেও পিঠ ছাড়ে না সহজে। অনেক সাধনার পরে চয়নের জন্ম হয়েছে। তাই সবার কাছে আদরও একটু বেশি। কিন্তু ফসল চাষের ধুম পড়ায় কেউ আর তাকে কোলে নিতে আসে না। তাই চয়নকে বুকে জড়িয়েই সে সকল কাজ সারছে। এটা তাদের জীবন-মরণের লড়াই। বর্ষাকালে ধান-পাট হলেও এই সময়ের ফসলই তাদের মুখে সবচেয়ে বেশি হাসি ফোটায়। এই ফসল বিক্রি করেই তাদের সারা বছর চলে।

সবুরকে নিয়ে একটা একটা করে পিঁয়াজ মাটিতে পুঁতছে আর নতুন স্বপ্ন বুনছে ওয়াদুদ। তার একটাই ইচ্ছা, চয়নকে সে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। এর জন্যই তাকে এখন অনেক পরিশ্রম করতে হবে এবং টাকা জমাতে হবে। সবুরের অবশ্য এখন আর তেমন কোনো স্বপ্ন নেই। সব ভাইয়ের কাজে সাহায্য করে যে টাকা পায় তা দিয়েই সে কোনোরকমভাবে সংসার চালিয়ে নেয়। বড়ভাই আজমলের অবশ্য অনেক সম্পত্তি। ইতোমধ্যে হজও করে এসেছেন। তিনি একেবারে কৃপণ না হলেও খুব হিসেবি। আর হিসেবি না হলে বড় হওয়া যায় না। গ্রামবাংলায় একটি প্রবাদ আছেÑ থাকতে রাইখা খাও, বেইল থাকতে বাড়ি যাও। সব ভাইয়ের সম্পত্তি সমানই ছিল। সবুর কাজলীর পেছনে ঘুরছে আর অযথা ব্যয় করেছে। তাকে স্কুলেও দেওয়া হয়েছিল। ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কিন্তু সে যখন অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে তখন কাজলীর প্রেমে পড়ে। এরপর অনেক কথা। কাজলীকে সে পায়নি। অতঃপর ভবঘুরে হয়ে যায়। বন্ধ করে দেয় পড়ালেখাও। এখনো স্কুলের শিক্ষকেরা সবুরকে দেখলে খুব আফসোস করেন। কারণ ওই সময় এরকম মেধাবী ছাত্র গ্রামাঞ্চলে কমই পাওয়া যেত।

অগ্রহায়ণ মাস। পিঁয়াজ-রসুন, ধনে, মসুর, কালোজিরা, কলইসহ সব ফসলের চাষ শেষ হলো। চারদিকে ছোট ছোট চারা গজিয়ে সবুজে ছেয়ে যাচ্ছে খেত। গ্রামের কৃষকেরা ভোর হতেই খেতের আইল দিয়ে হেঁটে সেই দৃশ্য দেখে আর মন ভরে যায়। শীতকাল না এলেও হালকা কুয়াশার সাথে কিছুটা ঠান্ডা পড়েছে। ওয়াদুদ সারাদিন খেতে ঘুরে ফসলের মাঠ দেখে। ফসলের মধ্যে কোনো ঘাস উঠলে কাঁচি দিয়ে উপড়ে ফেলে। সবুজে ভরা মাঠের অপরূপ দৃশ্য দেখে সে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফেরে।
একদিন রাতের বেলায় সে গায়ে পাতলা একটি কাঁথা জড়িয়ে চাঁদনীকে নিয়ে গল্প করছে। চয়ন ঘুমিয়ে মাটি হয়ে আছে। এতদিন শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেলেও এখন প্রায় অলস সময় কাটছে চাঁদনীর। তাছাড়া সামনে যখন ফসল ঘরে আনতে হবে তখন শুরু হবে আরেক যুদ্ধ। ফসল কেটে আনা, মাড়াই দেওয়া, আরও কত কত কাজ! তাই এখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে সবাই। গল্প করতে করতে একসময় চাঁদনীরও শীত শীত লাগছে। তাই সে ওয়াদুদের শরীরের সাথে ঘেঁষে বসে কাঁথাটার একটা অংশ নিজের শরীরে দিয়ে মাথাটা ওয়াদুদের বুকের ওপর রাখল।

স্বামীর প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে চাঁদনীর এতদিনের সকল কষ্ট উবে গেল। তার হৃদয় এতটা শীতল হলো যেন সে বরফের মতো গলে পড়ছে। ওয়াদুদ চাঁদনীর চুলে বিলি কাটছে। মাঝে মাঝে কপালে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার নরম ঠোঁট দুটিও। বিলি কাটতে কাটতে একসময় ওয়াদুদ চাঁদনীকে বুকে টেনে নেয়। এই বয়সেও যে ওয়াদুদ তাকে ভালোবাসার চাদরে নিয়ে আদরে ভরিয়ে তুলছে তা ভাবতেই চাঁদনীর চোখ দুটি ভিজে যায়। আজ তার কাছে মনে হচ্ছে, বিয়ের আগের রাতে বাবার ঠিক করা প্রতিষ্ঠিত বরকে রেখে সে যে একজন বেকার ছেলের সাথে পালিয়েছিল তা সার্থক হয়েছে। সেদিনের সেই দুঃসাহসিক কাজের কথা মনে করে সে একেবারে কেঁদেই দিলো। চাঁদনী খুব আবেগি মানুষ। সুখ-দুঃখ উভয় সময়েই কাঁদে। কিন্তু কেন কাঁদে তা সে নিজেও জানে না। এটা নিয়ে অনেকে তাকে কটু কথাও বলে। কিন্তু তাতে তার কিছুই আসে যায় না। কাঁদলে মনে শান্তি লাগে, সকল বেদনা মুছে যায়। এটাতেই সে সন্তুষ্ট।

বরফের মতো গলতে থাকা চাঁদনী কেন আবার মোমবাতির মতো গলছে? কিছুই ভেবে পায় না ওয়াদুদ। তাই সে এক যুগ আগের ঘটনার মতো চাঁদনীকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। চাঁদনী কি আজ তাকে সেদিনের মতো ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দেবে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওয়াদুদের মনে। কিন্তু চাঁদনী আবার মোমবাতি থেকে বরফ হয়ে গেল। সে-ও ওয়াদুদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এইভাবে আজীবন তোমার বুকের উমে রাখবা তো?’
ওয়াদুদ চাঁদনীর সিক্ত কোমল ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমৃতের স্বাদ নিতে নিতে বলল, ‘জীবন যদি থাইমা না যায় তাইলে বুকের উমও কহনো শ্যাষ হইবো না।’
চাঁদনী কাঁপছে, ওয়াদুদের ভালোবাসায় সে যেন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও নাক বাজিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু এই উমে যদি অন্য কেউ বাসা বান্ধে।’
‘এই জমিন শুদু আমার চাঁদনীর জন্য, যার দিকে তাকাইয়া হাজারডা বছর কাটাইয়া দেওন যায়।’ এই বলে ওয়াদুদ আর কিছুই বলতে পারল না। শুধু ভালোবাসার আদরে চাঁদনীকে নিয়ে হারিয়ে গেল। আর চাঁদনী গলতে গলতে মিশে গেল ওয়াদুদের শরীরে।

এত সুখ কি আর প্রকৃতি সয়? ওয়াদুদ আর চাঁদনীর সুখও সইতে পারল না প্রকৃতি। সইতে পারল না গ্রামবাসীর আরামের ঘুমও। চাঁদনীর মতোই যেন কেঁদে ভাসিয়ে দিলো চারদিক। সেই রাতেই ওয়াদুদের বলদ দুটি বজ্রপাতে মারা গেল। অগ্রহায়ণ মাসে তো সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু কোথা থেকে এলো এত বৃষ্টি? প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওয়াদুদের। চাঁদনী সেই যে তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে তো ঘুমিয়েছেই, আর কোনো খবর নেই। ওয়াদুদ চাঁদনীর হাত সরিয়ে দাঁড়াতেই চাঁদনী জেগে যায়। বজ্রপাতের বিকট শব্দে ভয়ে সে আবারও ওয়াদুদকে জড়িয়ে ধরে। বাইরে বলদের কয়েকবার হাম্বা ডাক শোনা গেল। ওয়াদুদের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। এই বলদ দুটিই যে তার বড় সম্বল। সাথে সাথে সে চাঁদনীকে সরিয়ে দরজার সামনে যায়। এত বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে যে বাইরে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। এ সময় সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চাঁদনী, ‘বলদ মরলে আবার কেনা যাইব কিন্তু তোমারে পামু কই? এক পা-ও আর বাইরে দিবা না। তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই।’
‘আরে মাগি বলদ দুইডা মইরা গ্যালে হাল চাষ করমু কী দিয়া? তুই পথ ছাড়।’ এই বলে ওয়াদুদ চাঁদনীকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে লুঙিতে মালকোঁচা মেরে গোয়ালঘরের দিকে দৌড় দিলো।

বাইরে প্রচণ্ড অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বজ্র পড়লেই কেবল প্রত্যক্ষ করা যায়। ওয়াদুদ সবকিছু উপেক্ষা করে গোয়ালঘরে গেল। অন্ধকারে এদিক-ওদিক হাতড়াচ্ছে সে। এ সময় তার হাতে একটি বলদ পড়ল। সে বুঝতে পারল এটি আর জীবিত নেই। এরপর আরেকটি খুঁজতে লাগল কিন্তু হাতে বাজছে না। এর মধ্যে আবারও জোরে বিদ্যুৎ চমকাল। গোয়ালঘরের চাল নেই। বজ্রপাতে পুড়ে গেছে। তবে সে এবার আরেকটি বলদ ঠিকই দেখল। কিন্তু এটাও মৃত।
আকাশের মতো ওয়াদুদের চোখ দুটিও আলগা হয়ে গেল। চোখের জল আর বৃষ্টির জল একাকার হয়ে গেল। সে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার এহন কী হইবো? হাল চাষ করমু কী দিয়া!’ কিন্তু বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার শব্দ মিলিয়ে যায়। সে এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথায় হাত দিয়ে গোয়ালঘরের বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এ সময় আরেকটি বজ্র গোয়ালঘরের পাশে পড়ল। এদিকে ঘরের ভেতর থেকে চিৎকারের শব্দ পাওয়া গেল। তবে আবছা আবছা। ওয়াদুদ তাড়াতাড়ি দৌড়ে ঘরে চলে গেল।

‘তোমারে বারহায় বারহায় বাইরে যাইতে না করলাম, ক্যামনে ঠাডা পড়তাছে। যদি কিছু হইয়া যাইতো তাইলে চয়ন কারে বাপ বইলা ডাক দিতো?’ শেষের কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দিয়ে থেমে গেল চাঁদনী। অন্ধকারের জন্য ওয়াদুদ অবশ্য সেটা প্রত্যক্ষ করেনি। শুধু এতটুকু বলল,
‘মরার আর বাকি রইল কী!’ চাঁদনী ওয়াদুদের শরীর গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ‘কিছুই মরে নাই। বাঁইচা আছো তাতেই অনেক কিছু। তুমি যে আমার মনের মাজে জ্বইলা থাকা আলো। তোমার ছায়া দ্যাখলেও যে পরনডা জুড়াইয়া যায়! তুমি আছো বইলাই পিথিবিটা এত সুন্দর লাগে! মন চায় তোমার মুকটার দিকে চাইয়া চাইয়া জীবনডা পার কইরা দেই। আর হেই তুমি সামান্য দুইডা বদলদের নিগ্গা ঠাডা উপেক্ষা কইরা গোয়ালঘরে চইলা গ্যালা? একবার ভাইবাও দ্যাখলা না তোমার কিছু হইয়া যাইলে এই পাগলিটার কী হইত? কার বুকে মাতা রাইখা শান্তির ঘুম দিতো? তাড়াতাড়ি লুঙ্গি পালটাও, নাইলে যে জ্বর আইয়া পড়তে পারে।’

এর মধ্যে সবুরের ঘর থেকে প্রচণ্ড কান্নার শব্দ শোনা গেল। ওয়াদুদ ভেজা লুঙ্গি নিয়েই দৌড় দিলো। সবুরের ঘরটি ছিল একেবারেই নড়বড়ে। থামগুলো ঘুণে ধরা। তাই সহজেই দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। সবুর বের হতে পারলেও তার স্ত্রী ও সন্তানেরা ভেতরে আটকা পড়েছে। বাতাসের বেগ বেড়ে ঘর নড়লে সবুরের স্ত্রী চিৎকার দিয়ে ওঠে, আবার থামলে সে-ও থেমে যায়। হয়তো তার বুক কিংবা গলার ওপরে কিছু পড়েছে। তবে বাচ্চাদের চিৎকার একটানাই চলছে।

ওয়াদুদ কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সবুরের কোনো হুঁশজ্ঞান নেই। সে যে কাঁদবে সেই শক্তিটুকুও নেই। সুতরাং এখানে তার ভূমিকা বলতে কিছুই নেই। তার ওপর বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। সবুরদের চিৎকারের শব্দ পেয়ে অন্য ভাইয়েরাও চলে এসেছে। অবশেষে সব ভাইয়েরা দা, কাঁচি ও শাবল এনে ঘরের বেড়া ও চাল খুলতে লাগল। ইতোমধ্যে তাদের সাথে পাড়া-প্রতিবেশীরাও যোগ দিয়েছে। প্রথমেই বের করা হলো সবুরের ছোট্ট মেয়েকে। সে একেবারে নিথর। এরপর একে একে দুই ছেলেকে। কিন্তু দুজনই প্রায় আধামরা। এই অবস্থা দেখে সবুর একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাসের কারণে ঠিকমতো উদ্ধারকাজ করা যাচ্ছে না। তবে সবকিছু উপেক্ষা করে সবাই ঘরের এক এক অংশ খুলে যাচ্ছে। একসময় সবুরের স্ত্রীকে পাওয়া গেল। তবে তার গলার ওপর বাঁশের নরা পড়েছে। বাতাসে নরা ওপরে উঠলে সে শ্বাস নিতে পারছে; আবার নামলে শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে সবাই ধরে সেই বাঁশ উঁচু করে সবুরের স্ত্রী আকলিমাকে উদ্ধার করল। আকলিমা হাতের ইশারায় পানি খেতে চাইল। মুখে এক ঢোক পানি নিতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরুষরা শক্ত থাকলেও মহিলাদের কান্নার রোল পড়ে গেল। ততক্ষণে অবশ্য গ্রামের মানুষ এসেও জড়ো হয়ে গেছে।

কাদায় পুরো বাড়ি যেন গোয়ালঘরে পরিণত হলো। এত রাতে সবুরের স্ত্রী ও দুই ছেলের চিকিৎসা কীভাবে করাবে? এলাকায় কোনো রাস্তাঘাট নেই। তার ওপর ঝড়-বৃষ্টি। ঝড়-বৃষ্টি কিছুটা কমলে নৌকায় করে এক মাইল দূর থেকে শিবচরণ ডাক্তারকে আনা হলো। কিন্তু তিনি এসে সবার পালস পরীক্ষা করে নীরব হয়ে গেলেন। কেউ বেঁচে নেই। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেমে গেছে। মসজিদ থেকে সুরেলা কণ্ঠে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে চারদিক ফরসা হয়ে এলো। পাটি বিছিয়ে একই সারিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে সবুরের স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়েকে। অবশ্য এখন আর তাদের কেউ নাম ধরে ডাকে না। সবার মুখেই একটি শব্দ ‘লাশ’।

সবুরের মেয়েটিকে দেখলে মনে হচ্ছে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। কী নিষ্পাপ শিশু! কেউ দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন মানুষের চোখের জলের বন্যা হচ্ছে। সবুর বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে বুক চাপড়ে বলে, ‘এহন আমার কী হইবো? হে আল্লাহ এ তুমি কী করলা? তুমি কি সরলের ওপর দিয়া গরল ঢাললা?’ পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে এই ধরনের কথা বলতে নিষেধ করছে। কিন্তু সবুরের যে প্রাণে আর সয় না। ‘হে আল্লাহ্ আমারেও ক্যান নিয়া গ্যালা না’Ñ এই বলে সে বুক চাপড়ে আবারও অজ্ঞান হয়ে গেল।

এমন রোজ কেয়ামত গ্রামবাসী আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। তাছাড়া অগ্রহায়ণ মাসে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। যদিও কখনো হয়েছে কিন্তু এতটা প্রকট ছিল না। সবুররা পাঁচ ভাই একসাথে বসে আছে। কারও কপালে হাত, কারও মাথায়, আবার কেউ থুতনিতে হাত ভর করে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন পাঁচ ভাইই বোবা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। একেক জন একেক দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে।

সবুর এখন মূর্ছা না গেলেও পাটিতে শুইয়ে রাখা লাশগুলোর দিকে পাথরের চোখে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে গ্রামের মোড়ল এসে সবুরের বড় ভাই আজমলকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। কারণ লাশের তো দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। সবুরদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। সেই মাঠেই বাদ জুম্মা জানাজা হয়। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব হলেও আজকে আর সবুরের কোনো আফসোস নেই। মাঠের কানায় কানায় মানুষে পূর্ণ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন মানুষের ঢল নেমেছে। এত মানুষ কোথা থেকে ও কীভাবে এলো তা জানে না সবুর। সামনের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটি আবছা হয়ে যায় আর ভেসে ওঠে স্ত্রী-সন্তানদের ছবি।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *