খেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যাদের জমি উঁচুতে তাদের কিছুটা ভালো আছে আর যাদের জমি নিচু সেখানে পানি জমে রসুন-পিঁয়াজ পচে গেছে। গ্রামের মানুষ থালাবাটি নিয়ে খেতে নেমেছে। জমিতে জমে থাকা পানি সেচছে। যদি কিছু হয়। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাকি নেই। এসেছে নতুন বউ আমেনাও। কেউ ড্রেন কাটছে, কেউ পানি উঠিয়ে বালতিতে ভরছে, আবার কেউ সেই বালতির পানি নিয়ে ড্রেনে ফেলছে। এ যেন এক মহাকর্মযজ্ঞ। সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখেই সবাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করছে। আস্তে আস্তে খেতের পানি শুকাচ্ছে আর বেরিয়ে আসছে ক্ষত। পিঁয়াজ-রসুনের পাতা ঢলে পড়ছে। জমি একেবারে শুকিয়ে ফাটল ধরলে দেখা গেল উঁচু জমির ফসলগুলোতে কিছু গুছি দিলেই হবে কিন্তু নিচু জমিগুলো আবার চাষ দিয়ে নতুন করে ফসল বুনতে হবে।

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বেশির ভাগ মানুষের বাড়িঘর নষ্ট হয়ে গেছে। গাছপালাও ভেঙে পড়ে অনেক ক্ষতি হয়েছে। গৃহপালিত পশু-পাখিও মারা গেছে অনেক। এর মধ্যে আবার নতুন করে ফসল চাষ করা কতটা কঠিন তা এই গ্রামবাসীই ভালো জানে। উঁচু জমি যাদের তারা অল্প কিছু পিঁয়াজ রসুন কিনে ফাঁকা জায়গায় গুছি দিলো। আর নিচু জমিতে চাষ দিয়ে সবাই ধনে-মসুরি বুনল। কারণ এখন আর পুরো খেতে নতুন করে পিঁয়াজ-রসুন কিনে লাগানোর মতো সক্ষমতা কারও নেই। তাছাড়া লাগালেও তা ভালো হয় না। কারণ এই ফসল আসতে আসতে অনেক শীত পড়ে যাবে। অতিরিক্ত কুয়াশায় পিঁয়াজ-রসুনের পাতায় মড়ক ধরে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। কারওই তেমন মন ভালো নেই। তারপরেও সবাই চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়াতে। ফয়েজকে নিয়ে খেতে নিড়ানি দিচ্ছে গফুর। হঠাৎ প্রকৃতির ডাক পড়লে সে খালের পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে। এর মধ্যে হঠাৎ করে কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দেয়। রাগ আর ক্ষোভে তার শরীর জ্বলছে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখে তার ছেলে রাশেদ হাসছে। মূলত প্রকৃতির কাজ সারার সময় রাশেদই তাকে ধাক্কা দিয়েছে। ফয়েজ যতটা ভয়ংকররূপে পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল ততটা আর থাকেনি। কিন্তু সে-ও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। রক্তের প্রবাহ একেবারে থামল না। খাল থেকে ওপরে এসেই ছেলের গায়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিলো। ওই যে এর আগে যেই লোকটি রাশেদকে টাকা দিয়েছিল, সেদিন কিন্তু সে-ই এই কাজটি করতে পারত। কিন্তু করেনি। বরং পাঁচটি টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাশেদকে দিয়েই বাবার সাথে কাজটি করাল। আর বাবাকে দিয়েই ছেলের বিচার করাল। রাশেদকে থাপ্পড় দিয়েও রাগ যাচ্ছে না গফুরের। তবে বারবার দাঁত চেপে ধরে সেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে সে।

কল্পনার মন-বাগানে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। গফুরের ঘরে সংসার করার মূল যে আকর্ষণ সেটাই নেই। সেটা অবশ্য কখনোই ছিল না। তবে সে বানিয়ে নিয়েছে। বাগানের মালিক গফুর হলেও মালির দায়িত্বটা ফয়েজের। কিন্তু সবুরের পুরো পরিবার মারা যাওয়ার পরে মালি আর বাগান পরিচর্যা করতে আসে না। বাড়িতে খুব কাজের চাপ। এত শোকের মাঝে শ্বাস বন্ধ লাগছিল আমেনার। তাই অনেক বলে কয়ে সে তার বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
এখন ফয়েজের বিয়ের আগের অবস্থাই হয়েছে কল্পনার। একা একাই সব কাজ সামলাতে হচ্ছে তাকে। চুলায় ভাত চড়িয়ে দিয়ে একটা ঝাড়ু নিয়ে সে পুরো উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসে আবার ঝাড়ু দেয়। কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না সে। ইদানীং তার শরীরটাও খুব জ্বলছে। অবশ্য দোষটা মনেরই। মন যা চায় তা পাচ্ছে না বলেই শরীরে যন্ত্রণা করছে। এ সময় খেত থেকে বাড়ি ফেরে ফয়েজ। খেতে নিড়ানি দিচ্ছে তারা। প্রচণ্ড কাজের চাপ। ফলে দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো। ফয়েজ খেয়ে গফুরের জন্য ভাত নিয়ে যাবে। কল্পনা ভাত বেড়ে দেয়, আবার ফয়েজের দিকে তাকায়। ফয়েজের পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, তাই সে গোগ্রাসে ভাত গিলছে।

এর মধ্যে একটি মাছের কাঁটা তার গলায় বিঁধে। সাথে সাথে সে তার ভাবি কল্পনাকে দেখতে বলে। কিন্তু কল্পনার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সে। তার চোখের নদীতে বিন্দু বিন্দু জলের রেখা জমে ঢেউ তুলে যাচ্ছে। ‘কী হইছে ভাবি? এমনে কানতাছো ক্যান?’ এই বলে সে নিজেই গলায় হাত দিয়ে মাছের কাঁটাটা বের করে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ল। কল্পনা ভেবেছিল তার চোখে জল দেখে ফয়েজও কাঁদছে। তাই নিজের বিরহ কাটিয়ে সে ফয়েজকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘থাক কাইন্দ না, সময় খারাপ হইলে সবদিক দিয়াই হয়।’
‘কই কানলাম, গলার মইদ্দে থেইকা কাঁটা বাইর করলাম তাই চোকে জল চইলা আইছে।’ এই বলে ফয়েজ সেই আগের মতোই তাড়াহুড়া করে খেতে লাগল। দেবরের চোখে জল দেখে কল্পনা যে একটু সান্ত্বনা পেয়েছিল তা একেবারে উবে গেল। রাগে তার শরীর জ্বলছে। তাই মুখ খুলে বলেই ফেলল, ‘শুদু নিজের প্যাডের দিক তাকাইলেই হয় না, অন্যেরটাও দ্যাখতে হয়।’ কল্পনা যে এটা দিয়ে কী বুঝিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইল না ফয়েজের। তবে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে খেতের দিকে পা বাড়াল। আর এদিকে ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকা কল্পনা বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ফয়েজের চলে যাওয়া দেখতে লাগল।

গফুর আলাদা ঘুমায়। এটা অবশ্য বিয়ের প্রায় বছরখানিক পর থেকেই। কল্পনার এক কথাÑ গফুর যদি তার সাথে ঘুমায় তাহলে সে এই বাড়িতে থাকবে না। প্রায় আট বছর আগের কথা। রাগ করে সে বাপের বাড়িতে চলে যায়। কারণ গফুরের নাকি শারীরিক সমস্যা আছে। বাবার কাছে লজ্জায় কিছুই বলতে পারে না কল্পনা। তাই সে তার মা জয়নাবান নেছাকে সব কথা খুলে বলে। তিনি আবার তার স্বামী মুবারক আকনকে জানান। মুবারক আকন তার স্ত্রীকে বলেন মেয়েকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে।
অতঃপর জয়নাবান নেছা কল্পনাকে অনেক বুঝান। তার এক কথাÑ ওইটাই তো সবকিছু না। সংসার বলতে আরও অনেক কিছুই আছে। সুতরাং বাকিসব যদি ঠিক থাকে তাহলে অবশ্যই তাকে স্বামীর সংসারে ফিরতে হবে। তাছাড়া তারা অনেক গরিব। কল্পনাকে বিয়ে দিতে তাদের অনেক ধার-দেনা করতে হয়েছে। সেই দেনাই এখন পর্যন্ত শোধ হয়নি। মাসে মাসে কিস্তি দিতে হয়। ফলে মুবারক আকনের সংসার চালাতে খুব হিমশিম খেতে হয়। অবশ্য কল্পনাদের পরিবারের সাথে গফুরের পরিবারের আত্মীয়তাও মানায় না। কিন্তু কল্পনার ওই সফেদ মুখটি দেখেই তারা আত্মীয়তা করে। যদিও গফুরের বড় ভাই রাগ করে বিয়েতেই যায়নি, তারপরেও গফুরের একক সিদ্ধান্তে এই বিয়ে হয়।

কল্পনাকে পেয়ে গফুরের মনের নদীতে যেই বাঁধভাঙা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা বেশিদিন প্রবাহিত থাকেনি। বছর না ঘুরতেই সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। জয়নাবান নেছার শত চেষ্টার পরেও গফুরের সংসারে না ফেরার বিষয়ে অটল থাকে সে। ফয়েজের তখন বয়স কম। কিন্তু হঠাৎ করে বেশ লম্বা হয়ে যায় সে। চুল রাখে বড় বড়। দেখতে একেবারে প্রিন্সের মতো। সব ভাইয়েরা কাজ করে আর সে ঘুরে ফিরে খায়। সবার ছোট বলে কেউ তাকে কিছু বলেও না। যখন যা চায় তাই পায় সে। তাছাড়া অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে কেউ তার সামনে কখনো জোরেও কথা বলেনি।
ভাবি বাড়িতে আসে না। বিষয়টা তার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না। কল্পনা এ বাড়িতে যতদিন ছিল ফয়েজ তার পিছু পিছু লেগে থাকত। মনে হতো যেন দুজন একেবারে ভাই-বোন। তাছাড়া কল্পনারও বয়স কম। কেবল কলি থেকে ফুল ফোটেছে। সে-ও দেবরের সাথে কোনো বাধা ছাড়াই হইহল্লা করত, ঘুরে বেড়াত। প্রথম দিকে স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার গোপন সম্পর্ক নিয়ে কল্পনার তেমন একটা মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু যখন সে ফুল ফোটে একেবারে পাপড়ি মেলতে শুরু করল তখন বুঝতে পারলÑ আসলে ভাত-কাপড়ই সব না, তার সাথে মনের ক্ষুধাও আছে। কিন্তু মনের ক্ষুধা না মিটলে যে শরীরটা খুব জ্বালায়।
কল্পনা বাবার বাড়িতে একরকম জোর করেই থাকছে। মনে হচ্ছে যেন এ বাড়িতে তার আর কোনো অধিকার নেই। বিয়ে হয়েছে তো বাবা-মায়ের কাছে পর হয়ে গেছে। যেখানে নিজেদেরই ভাত জোটে না সেখানে বিয়ে দেওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনা যেন একটা বিলাসিতা। বিকেল বেলা পশ্চিম আকাশে টকটকে লাল সূর্য বিদায়ের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এখনো পেটে কিছু না পড়ায় ক্ষুধায় পেট জ্বলছে কল্পনার। মুবারক আকন ভোর বেলায় পান্তা ভাত নিয়ে কামলা দিতে গেছেন । কল্পনা ভাত খেতে যায়। কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার মা কয়েকটি কচুরমুখি গরম পানিতে জ্বাল দিচ্ছেন। এগুলো অবশ্য তিনি রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে তুলে এনেছেন। কল্পনা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাত রান্ধ নাই মা?’ জয়নাবান নেছা অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। পাশে থাকা বটিটি উঁচু করে কল্পনার দিকে তাক করে বললেন,
‘এইহানে কি তোর কোনো ভাতার আছে যে তোর নিগ্গা চাইল আইনা রাখছে?’ মায়ের এমন হিংস্রমুখ কল্পনা কখনোই দেখেনি। ঘরে ভাত থাকত না অথচ নিজেরা না খেয়ে কল্পনার জন্য রেখে দিতেন। কল্পনা জিজ্ঞেস করলে তারা বলতেন, ‘আমরা রান্ধনের সময়ই খাইয়া হালাইছি।’ কথাগুলো মনে করে কল্পনার চোখের তটিনীতে বান নামল। চারদিকে সে আবছা দেখছে। পায়ের নিচের মাটি মনে হয় সরে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনোরকমভাবে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সে ঘাটায় এসে একটি মাচার ওপর বসল। এর মধ্যে তার কানে ভেসে এলো ছেলেকণ্ঠ, ‘ভাবি আমার খুব ক্ষুদা লাগছে, শিগগির ঘরে যাইয়া ভাত বাড়ো।’

ফয়েজ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে হাজির। সারাদিন দোকান থেকে হাবিজাবি খেলেও তাতে পেট ভরেনি তার। তাছাড়া তার ভাবিও যেহেতু বাড়িতে আছে সেই চিন্তা করেই সে এ বাড়িতে এসেছে। কল্পনা সাথে সাথে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সামনের দিকে তাকাতেই দেখল এক সিনেমার নায়ক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবড়ি চুল, শুকনো শুভ্র মুখ আর বিড়ালের মতো চোখ। সে-ও হয়তো তাকেই খুঁজছিল। কারণ তার এই দুরবস্থার মধ্যে কোনো নায়ক ছাড়া তো তাকে এত দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব না।
কল্পনা ফয়েজের কাছে গিয়ে একটি মিথ্যে হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি তো একটু নানা বাইত্তে গেছিলাম, এইমাত্র আইলাম। আর বাবা মায় এহনো আহে নাই। তাই ভাত রান্নাও হয় নাই। চলো তোমাগো বাইত্তে চইলা যাই এহন। বাইত্তে যাইয়াই ভাত খামুনে দুজন।’ ফয়েজ আর না করতে পারল না। এর মধ্যেই কল্পনা দৌড়ে ঘরে গিয়ে তার কাপড়ের ব্যাগটি এনে ফয়েজের হাতে দিয়ে বলল, ‘চলো তাইলে।’

জয়নাবান নেছা মেয়েকে অনেক অপমান করে এখন নিজেই জ্বলেপুড়ে মরছেন। যেখানে নিজেরা না খেয়ে মেয়েকে খাওয়াতেন সেখানে আজ মেয়ের মুখে সামান্য একটু অন্নও তুলে দিতে পারলেন না। বরং মেয়ের ওপর বঁটি নিক্ষেপের জন্য তাক করেছিলেন। ছেঁড়াফাটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন আর বোবা কান্না করছেন তিনি। তারই-বা কী করার ছিল? স্বামী কামলা দিয়ে টাকা রোজগার করে হাটে গিয়ে চাল আনবেন। তারপরই কেবল ভাত রান্না করতে পারবেন।
কচুমুখিগুলো সিদ্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো নামিয়ে তিনি ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। মেয়ে ক্ষুধার্ত, এখন কী করা যায়? হঠাৎ মনে পড়ল রান্নাঘরেই হাঁস-মুরগির জন্য কিছু খুদ রাখা আছে। তাই সেই খুদ বের করে কুলায় করে ঝেড়ে কিছু খুদ পাতিলে দিয়ে রান্না চড়িয়ে দিলেন। আর কচুমুখিগুলো ঠান্ডা হলে ভর্তা বানানোর জন্য ছুলতে লাগলেন। অতঃপর সরিষার তেল আর পোড়া মরিচ দিয়ে সেগুলো ভর্তা করলেন। ভাত রান্না হয়ে গেলে মাড় গেলে গামলায় বাড়লেন। এরপর পানির কল থেকে এক জগ পানিও আনলেন।
সবকিছু সম্পন্ন করে ঘরের কাছে গিয়ে কল্পনাকে ডাকলেন, ‘কল্পনা, এই কল্পনা। ভাত বাইড়া বইয়া আছি। শিগগির চুলাহালে আয়।’ মেয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি সাথে সাথেই ঘরের ভেতর গিয়ে আরও কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু কল্পনার কোনো খবর নেই। অতঃপর তিনি ঘাটায় গিয়েও কয়েকবার ‘কল্পনা, কল্পনা’ বলে জোরে জোরে ডাকলেন।
বয়সের স্রোতে জয়নাবান নেছার ভাঁজপড়া কপালে কালো মেঘ জমছে। ছানিপড়া চোখের কোণেও বিন্দু বিন্দু জলের রেখা ফুলে ফেঁপে উঠছে। এখন কী করবেন তিনি? কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। এদিকে ছেলেটাও বাড়িতে নেই যে তাকে বলবেন কল্পনাকে খুঁজে বের করতে। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি আবার রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় জ্বলতে থাকা কয়লার খাঁখাঁ আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে যেন এই কয়লার আগুন তার বুকেই জ্বলছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। হাঁসমুরগিগুলো খোঁয়াড়ের কাছে এসে ডাকছে। হয়তো জয়নাবান নেছার অপেক্ষাতেই আছে। অবশেষে জয়নাবান নেছা এসে এগুলোকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিলেন। এগুলোর জন্য অবশ্য খারাপও লাগছে তার। কারণ হাঁসমুরগির জন্য রাখা খুদগুলোই যে তিনি রান্না করে ফেলেছেন। তার কান্না আরও বেড়ে গেল। সহ্য করতে না পেরে তিনি আবার ঘরের ভেতর চলে গেলেন। একটা বাতি ধরিয়ে কল্পনার রুমে গিয়ে দেখলেন তার জামাকাপড়ের ব্যাগটিও নেই। এর মধ্যে মুবারক আকন চাল-ডাল হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। উঠানে দাঁড়িয়ে জোরে গলায় ডাকলেন, ‘কল্পনা, এই কল্পনা। শিগগির বাতি নিয়া বাইরে আয়।’
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি জয়নাবানকে ডাকলেন, ‘এই হুনছো? শিগগির বাতি নিয়া বাইরে আহো।’ জয়নাবান অবশ্য ‘কল্পনা, কল্পনা’ ডাক শুনেই বাতি নিয়ে বাইরে এসেছেন। স্ত্রীর চোখে জল দেখে মুবারক আকন সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার চোকে জল ক্যান? আর কল্পনা কই?’ জয়নাবান আর কোনো কথা বলতে পারলেন না, স্বামীর কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চোখ ভাসিয়ে বোবা কান্না করতে লাগলেন।

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *